জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের অধিকাংশ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং কর্মচারী কোটিপতি। তাদের নামে বেনামে রাজধানী ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, দোকানসহ অনেক জমি রয়েছে। তবে দুদকের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে কয়েক ডর্জন শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
প্রতিদিনই বাড়ছে এনবিআরের দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের তালিকা। যারফলে দুদক আতঙ্কে রয়েছেন এনবিআররের শতাধিক প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা। সরকার গত ২ জুলাই এনবিআরের তিন সদস্য ও এক কমিশনারকে অবসরে পাঠিয়েছে। তারা হলেন,এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেন, হোসেন আহমদ ও আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদ। তার মধ্যে শব্বির আহমেদ বরিশাল কর অঞ্চলে কমিশনারের চলতি দায়িত্ব পালন করছিলেন। তবে ইতোমধ্যে রাজস্ব আদায় বন্ধ রেখে রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্রোহ ঘোষণা দিয়ে সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে অসহযোগ আন্দোলনকারী ‘শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে শতাধিক রাঘববোয়াল চিহ্নিত হয়েছে।
সূত্র মতে, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং রাজস্ব আহরণের সুবিধার্থে দুইটি পৃথক বিভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গত ১২ মে দিবাগত রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অনুমোদনের পর অধ্যাদেশটি জারি করা হয়। এই অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আগের এনবিআর ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) বিলুপ্ত করা হয়। একই সাথে বর্তমান সরকার রাজস্ব খাতকে ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামে দুটি পৃথক বিভাগে ভাগ করে অধ্যাদেশ জারি করেছে।
এই অধ্যাদেশ জারির তীব্র বিরোধীতা করে সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের নামে লাগাতার কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেন এনবিআর এবং আইআরডির ‘টপ টু বটম’ কর্মকর্তা- কর্মচারীরা। অভিযোগ উঠেছে, ফ্যাসিস্টদের নির্দেশনার আলোকে সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য “মার্চ টু এনবিআর ও কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন দুর্নীতিবাজ বিপ্লবীরা। অবশেষে সরকারের শক্ত অবস্থান এবং আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগদানের নির্দেশ জারির পর তারা পুনরায় কাজে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
কমিশনারসহ আরো ৫ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু :
সূত্র মতে, ইতোমধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে বেশকয়টি টিম এনবিআরের কোটিপতি প্রভাবশালী রাঘববোয়ালদে ধরতে মাঠে নেমেছে। আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) এক কমিশনারসহ ৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। এই ৫ জন হলেন- ঢাকা পূর্বের কমিশনার (কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট) কাজী মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, বেনাপোল স্থলবন্দরের কমিশনার মো. কামরুজ্জামান, উপ কর কমিশনার মো. মামুন মিয়া, অতিরিক্ত কর কমিশনার (আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট) সেহেলা সিদ্দিকা ও কর অঞ্চল-২ এর কর পরিদর্শক লোকমান আহমেদ। এর আগে গত ১ জুলাই এনবিআরের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, সদস্য লুতফুল আজীম, সিআইসির সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, উপ-কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম ও যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান। এদের মধ্যে শিহাবুল ইসলাম, মো. তারেক হাছান, আব্দুল রশীদ মিয়া এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য।
এরআগে ২৯ জুন এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম, অতিরিক্ত কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি মির্জা আশিক রানা, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ মোরশেদ উদ্দীন খান, যুগ্ম কর কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সহ-সভাপতি মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, অতিরিক্ত কমিশনার ও এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান তারেক রিকাবদার ও অতিরিক্ত কমিশনার ও সংস্কার ঐক্য পরিষদের সদস্য সাধন কুমার কুন্ডুর বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। তারাসবাই এনবিআরের ‘শাটডাউন’ কর্মসূচির নেতৃত্বে ছিলেন।
কমিশনারসহ ৪ কর্মকর্তার বাধ্যতামূলক অবসর:
রাজস্ব আদায় বন্ধ রেখে রাজধানীসহ সারাদেশে বিদ্রোহ ঘোষণা দিয়ে সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারী রাঘববোয়ালরা চিহ্নিত হয়েছে। ইতোমধ্যে গত ২ জুলাই এনবিআরের তিন সদস্য ও এক কমিশনারকে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। তারা হলেন,এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেন, হোসেন আহমদ ও আবদুর রউফ এবং কমিশনার মো. শব্বির আহমেদ। তার মধ্যে শব্বির আহমেদ বরিশাল কর অঞ্চলে কমিশনারের চলতি দায়িত্ব পালন কর ছিলেন। গত ২ জুলাই অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি) থেকে পৃথক চারটি আদেশ জারি করা হয়।
আদেশে বলা হয়, তাদের চারজনের চাকরিকাল ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। যেহেতু সরকার জনস্বার্থে তাকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান প্রয়োজন হবে,এ বিবেচনায় সরকারি চাকরি আইন ২০১৮এর ৪৫ ধারার ক্ষমতা বলে তাদের দুজনকে সরকারি চাকরি হতে অবসর প্রদান করা হলো। তবে তারা দুজনেই বিধি অনুসারে অবসরজনিত সুবিধাদি পাবেন।এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, কয়েক দিন আগে এনবিআরে যে আন্দোলন হয়েছে, এর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই দুজন কর্মকর্তাকে অবসর প্রদান করা হতে পারে।
এর আগে গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মো. জাকির হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস বন্ধ রেখে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করায় তার বিরুদ্ধে এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে এ সংক্রান্ত আদেশ জারি হয়। এতে সই করেন আইআরডি সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান। আজ সকালে চট্টগ্রামের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিনকে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। রাজস্ব খাতে যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে গত ২৮ ও ২৯ জুন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে শুল্ক-কর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করেন। এতে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসসহ সারা দেশে শুল্ক-কর কার্যালয়ে কাজ বন্ধ থাকে।
মো. জাকির হোসেনের সাময়িক বরখাস্তের আদেশে বলা হয়, দপ্তর খোলা রাখার নির্দেশনা অমান্য করে গত ২৮ ও ২৯ জুন চট্টগ্রামের কাস্টম হাউস বন্ধ রেখে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ক্ষতি করায় মো. জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় কার্যধারা অনুসারে এনবিআর বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালে তিনি বিধি অনুসারে খোরপোষ ভাতা প্রাপ্য হবেন। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস হলো এনবিআরের সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী দপ্তর। বিদায়ী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছে এই দপ্তরের অধীনে।
এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন এনবিআরের ১১ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। তাদের মধ্যে এনবিআরের দুজন সদস্য আছেন। এ ছাড়া এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদারও আছেন। আলোচিত এনবিআর’এর প্রভাবশালী কর্মকর্তারা গত ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বিভিন্ন স্টেশনে চাকরিকালীন বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শুল্ক, ভ্যাট ও কর ফাঁকির সুযোগ করে দিয়ে ও নিজে লাভবান হয়ে রাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার মাধ্যমে দুর্নীত, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন অনেকে।
আ. দৈ./কাশেম