ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নগর ভবনে পুনরায় জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের নেতা আরিফ চৌধুরী এবং আরিফুজ্জামান প্রিন্স গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার (২৪ জুন) দুপুরে নগর ভবনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আরিফ চৌধুরীর অনুসারি মনির হোসেন (৪৫) ও মহিদুল ইসলাম (৩৫) মারাত্নক আহত হয়েছে। পরে তাদেকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
নগর ভবনে সংঘর্ষে আহত দেখতে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ছুটে যান, সিটি ও পৌর কর্মচারী ফেডারেশনের মহাসচিব ও ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক এসএম মোশাররফ হোসেন মিলন। তিনি ডিসিসির সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার আমলে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা গণমাধ্যমকে জানান, গত ৫ আগস্টের পর থেকেই নগর ভবনে আধিপত্য বজায় রাখতে শ্রমিক দলের দুই গ্রুপের মধ্যে বার বার সংঘর্ষ হচ্ছে। অথচ এতোদিন শ্রমিক দলের এইদুই গ্রুপেরই অভিভাবক বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। কিন্তু অবশেষে ইশরাকের সমর্থনে রেজিষ্ট্রেশন বিহীন অবৈধ সংগঠন ডিএসিসসি শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের স্বঘোষিত সভাপতি আরিফ চৌধুরী ও তার লোকজন নগর ভবনে লাগামহীনভাবে উশৃঙ্খল আচরন করে যাচ্ছে। যারফলে আজ তাদেরকে পিটিয়ে নগর ভবন থেকে বের করে দিয়েছেন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক কর্মচারী নেতা আরিফুজ্জামান প্রিন্স গ্রুপের লোকজন।
তারা জানান, বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে শপথ পড়ানোর দাবিতে গত ১৪ মে থেকে টানা ৪০ দিন পর নগর ভবন তালা বদ্ধ ছিল। গতকাল সোমবার (২৩ জুন) নগর ভবনে অফিস খোলার ঘোষণার পরে বহিরাগতদের নিয়ে নগর ভবনে আরিফ চৌধুরী ও তার অনুসারিরা শোডাউন করেন। তার সংস্থাপন শাখা এবং সচিবের দপ্তরে কর্মরত আরিফুজ্জামান প্রিন্স গ্রুপের কর্মচারীদের নাজেহাল করেন এবং নগর ভবন থেকে বের করে দেন।।
সোমবারের এ ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়ে নগর ভবনে অফিস খোলার নির্দেশ দাতা ইশরাক হোসেন। এরআগেও তিনি প্রতিহিংসা পরায়ন হয়েই নগর ভবনে ৬৫টি তালা মারার নির্দেশ দিয়েছেন। আবারে তার নির্দেশেই নগর ভবনে প্রশাসক ও প্রকৌশল বিভাগ তালা বদ্ধ রাখা হয়। এছাড়া বাকি দপ্তরের তালা খোলা হলেও তার সমর্থিতদের হট্টগোলের কারণে নগরবাসী আজো সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সাধারণ কর্মচারীরা আক্ষেপ করে বলেন, ডিএসসিসিতে শ্রমিক দলের নেতা ও কর্মীরা ইশরাক হোসেনের নিয়ন্ত্রণে নেই। যতই দিন যাচ্ছে ডিএসসিসির পরিবেশ পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ অবনতির দিকে যাচ্ছে। আর সেই সাথে ইশরাকে হোসেনর গ্রহণ যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা নিয়ে নানা প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে নগর ভবন সহ ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে শ্রমিক দলের এই দুই গ্রুপের মধ্যে পরবর্তীতে আরো বড় ধরনের সংঘর্ষে লাশ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তারা আরো জানান, গত ২৩ জুন দলবল নিয়ে নগর ভবনের কয়েকটি দপ্তরের তালা খুলে দেন শ্রমিক দলের আরিফ চৌধুরী ও তার অনুসারিরা। কিন্তু প্রশাসক ও প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তাদের কক্ষগুলোতে তারা তালা লাগিয়েই রাখেন। ফলে এই বিভাগেরে জরুরি সেবামূলক কাজ বন্ধ রয়েছে। গতকালও নগর ভবনে বহিরাগতদের নিয়ে মহড়া দেন আরিফ চৌধুরী।
আজ মঙ্গলবার (২৪ জুন) সকাল ৯টার পরপর নগর ভবনে আগের দিনে মতো অবস্থান নেন আরিফ চৌধুরী ও তার অনুসারীরা। এসময় তারা ইশরাক হোসেনকে মেয়র পদে শপথ পড়ানো ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেন। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে শ্রমিক দলের নেতা আরিফুজ্জামান প্রিন্স গ্রুপের লোকজন আরিফ চৌধুরী ও তার অনুসারিদের ধাওয়া করেন। তখনই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একপর্যয়ে মারখেয়ে নগর ভবন থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান আরিফ চৌধুরী ও তার লোকজন। অবস্থা বেগতিক দেখে ইশরাক সমর্থক বহিরাগতরাও পালিয়ে যায়।
ডিএসসিসির কর্মচারী জানান, আগে শ্রমিক দলের দুটি পক্ষই বিএনপি নেতা ইশরাকের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু ইশরাকের শপথের নামে নগরবাসীকে জিম্মি করা এবং সরকারি অফিস তালা দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরিফুজ্জামান প্রিন্স দূরে থাকেন। তিনি নগর ভবনে তালা দিয়ে নাগরিকদের ভোগান্তির বিরোধিতা করেন। এছাড়া নগর ভবনে তার বৈধ কমিটি আছে। আরিফুজ্জামান প্রিন্সের কমিটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর রয়েছে। তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এবং নগর ভবনের কেয়ারটেকার। কিন্তু আরিফ চৌধুরী যে সংগঠনের সভাপতি তার কোনো রেজিস্ট্রেশন নেই।
আজ আরিফুজ্জামান প্রিন্স গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ইশরাক হোসেন নগর ভবন চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। তার এই ঘোষণার পরও গত সোমবার বহিরাগত কিছু লোক প্রতিদিন নগর ভবনে মহড়া দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানি করেন। আজ মঙ্গলবার আমরা যখন অফিসে যাই, তখন আমাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়। তখন বাগবিতণ্ডার পর তারা আমাদের ওপর হামলা করা হয়। পরে করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মিলে তাদের ধাওয়া দিয়ে নগর ভবন থেকে বের করে দেন।’
অপরদিকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আরিফ চৌধুর গণমাধ্যমকে বলেন, আজ তারা নগর ভবনে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। কিন্তু বহিরাগতরা নগর ভবনে এসে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের পাঁচজনকে গুরুতর আহত করেছে।
সূত্র মতে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিত চলমান পরিস্থিতি, সেবা কার্যক্রম এবং ঢাকাবাসীর আন্দোলন নিয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে ছিলেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। আজ মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৪টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নগর ভবনে সংঘর্ষের ঘটনার পর তিনি সংবাদ সম্মেলন স্থগিত করেছেন তিনি। তবে আগামীকাল বুধবার (২৫ জুন) দুপুর ১২টায় এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য এর আগেও গত ২৯ মে দুপুর সাড়ে ১২ টায় নগর ভবনে আধিপত্য বজায় রাখতে আরিফ চৌধুরী এবং আরিফুজ্জামান প্রিন্স গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ওইদিন নগর ভবনে ভাংচুর, প্রতিপক্ষের হামলায় আরিফুজ্জামান প্রিন্সসহ ৫/৭ জনকে মারাত্নকভাবে আহত হয়। একই সঙ্গে আহতদের কাছ থেকে মোবাইল ও নগদ টাকা কেড়ে নেয়ার অভিযোগে ডিএমপির শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়।
আরিফুজ্জামান প্রিন্সের লিখিত অভিযোগটি পরদিন ৩০ মে নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়েছে। মামলা নম্বর ৩৮। কিন্তু ওই দিনের ঘটনায় থানায় মামলা দায়েরের পরও শ্রমিক দলে দুই গ্রুপের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও বিরোধ নিষ্পত্তির কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন। কথিত শ্লোগান আছে, ইশরাক হোসেন জনতার মেয়র, ঢাকাবাসীর নেতা। তবে তিনি ডিএসসিসির শ্রমিক কর্মচারীদের বিষয়ে উদাসীন। যারফলে নগর ভবনে শ্রমিক দলের নেতা- কর্মীদের একাধিক গ্রুপ এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থামছে না।