ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) রাজস্ব বিভাগকে নানা কৌশলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুনিদিষ্ট অভিযোগ উঠেছে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এবং তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রপতির দপ্তরের অনুমোদনের পর এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত গেজেট/ প্রজ্ঞাপনে উল্লেখিত আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে নিজেদের ইচ্ছা মতো একের পর এক আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু করছেন ডিএনসিসির প্রশাসক ও তার লোকজন।
তার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ফলে ডিএনসিসি কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাতে বসেছে। একই সাথে এক বছর মেয়াদী এই প্রশাসকের মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিধি লঙ্ঘণ নগরীতে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের সাথে জড়িত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আগামীতে , ক্ষমতার অপব্যবহার ,দুর্নীতি এবং ডিএনসিসির রাজস্ব তসরুপের সুনিদিষ্ট অভিযোগ ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত হবার বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হচ্ছে।
এদিকে নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএনসিসির একাধিক সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা ’এই প্রতিনিধিকে জানান, নতুন হোল্ডিং ট্যাক্স ধার্যের ক্ষেত্রে আইনে পরিস্কার বলা আছে আবাসিক এলাকায় বার্ষিক আয়ের ১২ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক এলাকায় ২৩ শতাংশ ধার্য় করতে হবে। ১২ মাসে বছর হলেও ট্যাক্স ধার্য করা হয় ১০ মাসের আয়ের ওপর হিসেব ধরে। এরপর সংশ্লিষ্টরা আবেদন করলে আপিল বোর্ড কমাতে পারেন, সেটাও আইনে বলা আছে। এই আইন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই কার্যকর রয়েছে। আইন মেনেই ২০১৮ সালের ১৮ এপ্রিলে ডিএনসিসির এক অফিস আদেশে গত ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের ডিএনসিসিতে নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের পৌরকর ধার্য ও আদায় শুরু হয়। গত অর্থবছর পর্যন্ত ওই আইনে নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায় করা হয়েছে।
কিন্তু বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজের নির্দেশনায় হঠাৎ করে গত ২৩ মার্চ ( ২৩/৩/২০২৫) ডিএনসিসির কর্পোরেশন সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে গত ২০১৭- ১৮ অর্থ বছরের চতুথ কির্স্তি থেকে আবাসিক পৌরকর ১২% এর স্থলে ৭% এবং বাণিজ্যিক পৌরকর ২৩% এর স্থলে ৭% হারে ধার্য ও আদায় কার্যকর করতে হবে। তাদের এই সিদ্ধান্তের ফলে গত ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের ৪র্থ কিস্তি থেকে আগের আদায় করা হোল্ডিং ট্যাক্সের কয়েক হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে ।ইতোমধ্যে আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রায় ৪২% এবং বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রায় ৭০% টাকা। ফলে ডিএনসিসিতে লাল বাতি জ্বালাতে আর বেশি সময় লাগবে না।
এদিকে আলোচিত অভিযোগ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সব কিছু করা হচ্ছে রাষ্ট্রের আইন ও বিধি মেনেই করা হচ্ছে। আইনের বাইরে তিনি কোনকিছু করছেন না। ডিএনসিসির রাজস্ব ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণ তো ট্যাক্স দিতে চায় না, তাই রেট কমানো হচ্ছে। তার দ্বারা ডিএনসিসির কোন ক্ষতি হচ্ছে না। ২০১৭-১৮ থেকে আদায় করা ট্যাক্স কেনো ফেরত দিচ্ছেন কেনো এর জবাবে তিনি বলেন, এটাও ডিএনসিসির স্বার্থেই ফেরত দেওয়া হচ্ছে। আগামীতে দুর্নীতি এবং ডিএনসিসির রাজস্ব তসরুপের অভিযোগ সংম্লিষ্ট কর্মকর্তা- কর্মচারীদের সাথে তার বিরুদ্ধেও ফৌজদারী অপরাধের অভিযোগ আসলে কিভাবে মোকাবেলা করবেন জানতে চাইলে প্রশাসক বলেন, যেহেতু সরকারের আইন মেনেই সব কিছু করা হচ্ছে, সেহেতু ভয়ের কোন কারণ নেই।
ডিএনসিসির অভিজ্ঞ সাবেক একাধিক কর্মকর্তারা বলেন, হঠাৎ প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যায়ে ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে হোল্ডিং ট্যাক্স আদায়ের নামে পৌরকর মেলার আয়োজন করেছেন। আগামীকাল রোববার (১১ মে) সরকারি ছুটির দিন ডিএনসিসির প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয় চত্বরেএই কর মেলা আনুষ্ঠানিক ভাবে উব্ধোধন করা হবে। এই মেলা চলবে ৩০ মে পর্যন্ত। ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ মহাখালীস্থ আঞ্চলিক কার্যালয় চত্বরে আয়োজিত অঞ্চল-৩ এর পৌরকর মেলা উব্ধোধন করার কথা রয়েছে। এই মেলা পরিচালনায় থাকছেন ডিএনসিসির নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বাইরের স্বেচ্ছা সেবকরাও।
ডিএনসিসির কর্মকর্তা আরো জানান, প্রতিবছর ‘ মে এবং জুন মাসে’ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে রাজস্ব বিভাগে হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদানের জন্য নগরবাসী লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন। অনলাইনে ‘এজেন্ট ব্যাংকগুলোর’ নির্ধারিত বুথে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা জমা হয়। কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বকেয়া ট্যাক্সের সিহেব করে টোকেন সরবরাহ করা নিয়ে থাকের মহাব্যস্ত। পৌরকর মেলার কোন প্রয়োজন হয় না। তবে এসব পৌরকর মেলার আয়োজন হয় সাধারণত ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাসে। তখন ঝড় বৃষ্টির থাকে না ফলে খরচ কম হয় এবং সিটি করপোরেশন বেশি লাভবান হয়। নতুন কর বছরে পৌরকর আদায় বাড়ে।
তারা আরো জানান, নতুন প্রশাসক দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে একর পর এক ডিএনসিসির স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এরমধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো; গাবতলী পশুর হাটের ইজরায় ভয়াবহ দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের নজির স্থাপন করেছেন। টার্গেট ১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা, অথচ সবোর্চ্চ দর উঠেছে ২২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর সাথে যুক্ত হবে সরকারের নির্ধারিত ভ্যাট ও ট্যাক্স। যা ডিএনসিসির টার্গেটের চেয়ে অনেক বেশি টাকা । কিন্তু ওই দরদাতাকে গাবতলী পশুর হাট ইজারা না দিয়ে বহিরাগত লোকজনের সহযোগিতায় খাসকালেকশন শুরু করেছেন প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। আর এই ঘটনায় দুদকের পক্ষ থেকে সরাসরি অভিযান চালানোর পরও প্রশাসক স্থানীয় এক বিএনপির নেতার সেল্টারে অবৈধভাবে গাবতলী পশুর হাটের কথিত খাসকালেকশন চালিয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাইনয়, গত ৫ মে যৌথবাহিনীর অভিযানেও গাবতলী হাট থেকে বহিরাগত ৪/৫ জনকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন।
সূত্র মতে, প্রশাসকের পক্ষ থেকে এই মেলায় সম্পূর্ণ বকেয়া পৌরকরের উপর সাড়ে ৭ শতাং সারচার্জ মওকুফ করার ঘোষণা রয়েছে। হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর নির্ধারিত পরিমান সারচার্জ মওকুফের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয় কিংবা ঢাকা উত্তর সিটির বোর্ড সভায় অনুমোদন নেয়ার বিধান এবং রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ পৌরকর মেলায় হোল্ডিং ট্যাক্সের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারিত সারচার্জ মওকুফের বিষয়ে বোর্ড সভায় কিংবা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা যায়।
জানা যায়, গত ৬ মে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌরকর মেলা বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামানের সভাপতিত্বে রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তাদের একটি মিটিং হয়েছে। ওই মিটিংযে প্রতিটি অঞ্চল থেকে পৌরকর মেলায় সম্বাব্য খরচের একটা চাহিদা দিতে বলা হয়েছে। পরে প্রতিটি আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে সম্ভাব্য খরচের একটা বাজেট তৈরি করে প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তার দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। ১০ টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে ২৪টি ভেন্যু (প্যান্ডেল) তৈরিসহ আনুুষঙ্গিক খরচ বাবদ মোট ৮৬ লাখ হাজার ৭৭ হাজার ২৪০ টাকার হিসেব পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে আরো অনেক খরচ রয়েছে যা এখনো আলোচনায় আসেনি। সব মিলে প্রায় ৩ কোটি টাকা হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
আ. দৈ./কাশেম