ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চলতি অর্থ বছরের শুরুতেই বাজেটের পুরো অর্থ নানা উন্নয়ন ঢ সংস্কারমূলক প্রকল্প এবং বড় বড় কেনা কাটাসহ বিভিন্ন কাজের নামে ব্যায় দেখিলে লোপাটের মিশন বাস্তবায়নে নেমেছে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমান এবং প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন মিয়া ও প্রশাসকের কথিত আত্মীয় বহিরাগত মাহবুবুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
ডিএনসিসিতে অস্বভাবিক ক্ষমতাবান এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ‘টু শব্দ টা’ করার সাহস কারো নেই। ইতোমধ্যে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা কৌশলে এইসিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
এদিকে ডিএনসিসিতে বহুল অলোচিত অভিযোগ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে তার হোয়াটস অ্যাপে ফোন করলে, তিনি ফোন গ্রহণ করেননি। ফলে তার ব্ক্তব্য নেওয়া যায়নি।
তবে ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফুর রহমানের সাথে টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি আজকের দৈনিক পত্রিকাকে স্পষ্টভাষায় বলেছেন, প্রশাসকের কথিত সিন্ডিকেটের সাথে তিনি জড়িত না। উন্নয়ণ ও সংস্কার মূলক কাজের টেন্ডার কমিটিতে তিনি নেই। টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটিতেও তিনি নেই। সব কাজ হচ্ছে ই টেন্ডারে এবং ১০ শতাংশ কমে ঠিকাদাররা কাজ নিচ্ছেন । এখন ভালো কাজ হচ্ছে। অগ্রীম কমিশন ভাগাভাগি ও কাজ বন্টন, প্রকৌশলীসহ কর্মকর্তাদের বদলি ও পোর্স্টং সংক্রান্ত কোন কিছুতেই তিনি জড়িত না। তার মূল কাজ হচ্ছে ডিএনসিসির কাজগুলো সুপারভিশন করা। যারা এসব অভিযোগ তোলালছেন, তারা মিথ্যাচার করছেন।
অপরদিকে নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএনসিসির একাধিক পদস্থ্য কর্মকর্তা আক্ষেপ করে জানান, বর্তমান প্রশাসকের দপ্তরটি একটি দুর্নীতির আখঁড়ায় পরিনত হয়েছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের দুর্নীতিবাজ সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেটের বেশ কিছু সদস্য নিজেদের স্বার্থে প্রশাসকের সিন্ডিকেটের সাথে যুক্ত হয়েছেন। ফলে ফি স্টাইলে ডিএনসিসিতে চলছে প্রতিটি টেন্ডার কাজ অগ্রীম ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমিশন ভাগাভাগি এবং পছন্দের লোকজনকে কার্যাদেশ দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে গত বছর জুলাই আগস্টে গণআন্দোলনকালে ডিএনসিসির মিরপুর ১০ নম্বরে আঞ্চলিক কার্যালয়-৪ এর ভেতরে রাখা প্রায় অর্ধ কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি, পেলোডার,ডাম্পারসহ পোড়া ও ক্ষতিগ্রস্ত মালামালগুলো সম্প্রতি গোপন আতাতের মাধ্যে মাত্র ২৬ কোটি টাকায় ‘ সোয়েল এন্টারপ্রাইজে’র কাছে বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছ থেকে প্রায় ১০ শতাংশ অগ্রীম কমিশন ভাগাভাগির বিষয়টি জানাজানির পর ডিএনসিসিতে প্রচন্ড ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা আরো জানান, প্রশাসকের এই সিন্ডিকেটটি ইতোমধ্যে কয়েক শত কোটি টাকার কাজ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করেছেন। আরো নতুন নতুন প্রকল্প আবিস্কার করা হচ্ছে। তাদের টার্গেট আগামী ৩/ ৪ মাসের মধ্যে বাজেটের ৮০ শতাংশ উন্নয়ন ও সংকার মূলক কাজের টেন্ডার সম্পন্ন করে পছন্দের ঠিকাদারদেরকে মোটা অংকের অগীম কমিশন নিয়ে কার্যাদেশ দেওয়ার নীল নকশা বাস্তবায়ন করা হবে। শুধু তাইনয়, দুই তিন জন পছন্দের ঠিকাদারকে কার্যাদেশ দেওয়ার পাশাপাশি পুরো বিল অগ্রীম প্রদানের টাগেট নিয়ার বিষয়টিও আলোচনা উঠে এসেছে।
তারা আরো জানান, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী অরিফুর রহমান,প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন মিয়া ও প্রশাসকের কথিত আত্মীয় বহিরাগত মাহবুবুর রহমানের এই সিন্ডিকেট নগর ভবনের বাইরে ‘আন্তর্জাতিক মানের অভিজাত হোটেলে’ গোপনে মাঝে মধ্যে বৈঠক করে বড় বড় কাজগুলো ভাগাভাগি করেন বলে ‘টপ টু বটম’ আলোচনা চলছে।
প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ দায়িত্ব গ্রহনের পর থেকে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একচেটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ডিএনসিসিকে একটি সাবেক মেয়র আতিকের দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকার লোপাট, স্বজনপ্রীতি, বদলি, সুবিধাজনক দপ্তরে পদায়নের নামে রমরমা বাণিজ্যকেও ছাড়িয়ে গেছে।
সূত্র মতে, ডিএনসিসিতে বর্তমান প্রশাসনের আমলে গত ফেব্রুয়ারিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অবসর প্রাপ্ত ও মৃত্যু কর্মচারীদেরে পরিবারের সন্তানদের মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে বিনা টাকায় দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে চাকরি দেওয়ার নামে প্রত্যেকের কাছ থেকে গড়ে ২ লাখ/ ৩ লাখ টাকা হিসেবে প্রায় ৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এই অপকমের সাথে জড়িতদের মধ্যে প্রশাসকের দপ্তর, তৎকালীন দায়িত্ব প্রাপ্ত সচিব বর্তমান সমাজ কল্যান ও বস্তিউন্নয়ন কর্মকর্তা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা, শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ের একাধিক নেতা, ক্লিনার অ্যাসোসিয়েশনের স্বঘোষিত সভাপতি জিয়াউর রহমানের কমিটির একাধিক নেতা জড়িত। তারা ইতোমধ্যে নিয়োগ,বদলি ও পদায়ন বাণিজ্যের মাধ্যমে আঙ্গুল ফোলে কলাগাছ হয়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ রয়েছে দুদকে। তবে দুদকের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগসহ সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আগের ভয়াবহ লোপাট এবং দুনীতির বেশ কিছু গুরুতর অভিযোগ অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
সূত্র সতে, প্রশাসকের বর্তমান এই সিন্ডকেটে কথিত বিএনপির নামধারী দুই/ একজন কর্মকর্তা ও জাতীয়তাবাদী পরিচয়দানকারী একাধিক নেতা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে যুক্ত হয়েছেন। তারা ইতোমধ্যে কয়েক দফা গোপন বৈঠক করেছেন। ওইসব বৈঠকে নিরীহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে হয়রানীমূলক বদলি ,এমনকি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাইরের সিটি করপোরেশন এবং পৌর সভায় বদলির নীল নকশা বাস্তবায়নের বিশাল তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সম্প্রতি ডিএনসিসির তথ্য কর্মকর্তা ফারজানা ববিকে ঢাকার বাইরে গাজীপুর জেলায় ‘কালিয়াকৈর পৌর সভায়’ বদলি করা হয়েছে। অথচ ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর এবং দুর্নীতিবাজ বেশ কয়জন কর্মকর্তাকে স্বপদে ও স্বদপ্তরে বহাল রেখে আরো সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর ফন্দি ফিকির চলছে।
ডিএনসিসির নাম না প্রকাশের শর্তেকর্মকর্তারা আরো জানান, বর্তমান প্রশাসন রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির নামে অতিমাত্রায় ডিজিটাল পদ্দতিতে নতুন‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’ প্রদানে এই প্রতিষ্ঠানের বারোটা বাজিয়েছেন। ভুয়া কাগজ পত্র ও ভুয়া ঠিকানায় ইতোমধ্যে কয়েক হাজার ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু হয়েছে ডিএনসিসিকে। ফলে যাচাই বাছাই ছাড়া দ্রæত নতুন‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’ খাতে ডিএনসিসি প্রায় ২/৩ শত কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে । কারণ আবাসিক এলাকায় ১০/১৫ বছরের পুরনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নতুন‘ ট্রেড লাইসেন্স’ ইস্যু হয়েছে আবেদনকারী ইচ্ছে মতো কিছু ফি নির্ধারণ করেই।
তবে যাচাই বাছাইকালে এসব জালিয়াতির চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। যে নতুন‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’ ইস্যু হয়েছে মাত্র দুই/ তিন হাজার টাকায় অথচ ওই নতুন‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’ যাচাই বাছাই করে বকেয়া ফি সহ আদায় হবার কথা ৩০ হাজার টাকা থেকে ৩৫ হাজার টাকা। ডিএনসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে বর্তমানে‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’ যাচাই বাছাইকালে এসব জালিয়াতির তথ্য বেরিয়ে আসছে। ইতোম্যধে স্থগিত করা হচ্ছে অধিকাংশ নতুন‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’। এই খবরে হুমকি খেয়ে পড়ছেন জালিয়াতির মাধ্যমে সহজে নতুন‘ ই ট্রেড লাইসেন্স’ প্রাপ্তরা। আর এই সুযোগ ডিএনসিসির সংশ্লিষ্ট ‘ট্রেড লাইসেন্স ও বিজ্ঞাপন সুপারভাইজার এবং তাদের নিয়োগকরা বহিরাহত দালালচত্র নানা কৌশলে ব্যবসায়ীদের পকেট হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
আরো জানা যায়, রাজস্ব বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বৈঠকে আঞ্চলিক কার্যালয়ে কর্মরত কর কর্মকর্তা (টিও) এবং উপ কর কর্মকর্তারা (ডিটিও) ভয়ে প্রশাসনের অবৈধ আদেশ ও লোপাটের বিরুদ্ধে মতামত প্রদান করা কিংবা কথা বলার সাহস পায় না। কথা বললেই তাদের বিরুদ্ধে হয়রানীমূলক বদলি, এমনকি ঢাকার বাইরে সিটি করপোরেশন এবং পৌর সভায় বদলির হুমকি রয়েছে। এসব বিষয় দেখার যে কেউনেই। সরে জমিন তদন্ত হলে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে ধারনা ডিএনসিসির কর্মকর্তা কর্মচারীদের।
আ. দৈ/ কাশেম