ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার গত বছর (২০২৪) জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোতে গুলি করে গণহত্যা চালিয়েছে। ওই গণআন্দোলনে দেড় হাজারের অধিক মানুষ হত্যা করেছে । আহত করেছে প্রায় ১৪ হাজার ছাত্র-জনতাকে। গণঅভ্যুত্থানে মাঠপর্যায়ে থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন সাংবাদিকেরা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হন ছয় সাংবাদিক। চোখের সামনে গুলিতে একের পর এক হত্যা, রক্তাক্ত শরীর ও আহাজারি দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন সাংবাদিকরা।
এদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সারাদেশে ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে গণমাধ্যমগুলো অচলাবস্থার মুখে পড়ে। ওই সময়ে দেশে প্রায় ১০ দিন মোবাইল ইন্টারনেট ও পাঁচদিন ব্রডব্যান্ড বন্ধ ছিল। ইন্টারনেট না থাকায় সংবাদকর্মীরা তথ্য সংগ্রহ, যাচাই ও পাঠানো—সব প্রক্রিয়াতেই বাধাগ্রস্ত হন। বন্ধ থাকে জাতীয় ও স্থানীয় অনেক পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ। সময়মতো প্রকাশিত হয়নি ছাপা সংস্করণও। ফলে সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত সহস্রাধিক সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রযোজক এবং কারিগরিকর্মী চরম মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন।
চারদিকে যখন লাশ আর গুলির শব্দে আতঙ্ক বাড়তে থাকে, মৃত্যু হাতে নিয়েই রাজপথ থেকে অফিস কিংবা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন সংবাদকর্মীরা। প্রতিটি ক্ষণ যেন মৃত্যুর সঙ্গে আলিঙ্গন করেই পথচলা ছিল তাদের। গণঅভ্যুত্থানে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হন সাংবাদিক আবু তাহের মো. তুরাব, হাসান মেহেদী, প্রদীপ কুমার ভৌমিক, মো. শাকিল হোসেন (পারভেজ), সোহেল আখঞ্জী ও তাহির জামান প্রিয়।
একাধিক সাংবাদিক জানিয়েছেন, আন্দোলনে তুমুল উত্তেজনার মধ্যে তথ্যের স্বাধীন প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হিসেবে এসেছে। কোনো ধরনের আপডেট না পেয়ে অজানা আশঙ্কা ও আতঙ্কে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেক সাংবাদিক শারীরিক অসুস্থতাও অনুভব করেন।
রাজধানীর একটি সংবাদপত্রের মাল্ডিমিডিয়া প্রতিবেদক শিমুল খান বলেন, ‘আমরা চোখের সামনে ঘটনা ঘটতে দেখেছি, কিন্তু সে খবর মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এমন বেদনা পেশাজীবনে আর কোনোদিন পাইনি। তথ্যপ্রবাহ ব্যাহত করা রাষ্ট্রের জন্যও ক্ষতিকর বার্তা বহন করে।’
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শাখাওয়াত জুলাই আন্দোলনকালে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘ইন্টারনেট বন্ধের মাঝেও নিউজের জন্য আমরা বাইরে বের হয়েছিলাম। ওই সময়ের অবস্থা করোনা মহামারির সময়ের মতোই মনে হচ্ছিল। করোনার ভয় ছিল আক্রান্ত হওয়ার আর জুলাই মাসের ভয় ছিল কখন কোথা থেকে গুলি এসে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। সাংবাদিকতা পেশায় যে চরম ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ ছিল তা জুলাই আন্দোলন না এলে বোঝা যেত না। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে নারকীয় ভূমিকা ছিল তা আজও চোখে ভাসে।’
সাংবাদিক তৌহিদুজ্জামান তন্ময় জুলাই আন্দোলনকালে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আন্দোলনের শুরু থেকেই মাঠে ছিলাম। দায়িত্বের টানে সব ঝুঁকি উপেক্ষা করে ফ্রন্টলাইনেই ছিলাম। নির্ভয়ে সত্য প্রকাশের তাড়নায় দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এখনও গণঅভ্যুত্থানের সেই সময় পুলিশের বর্বরতার স্মৃতি বারবার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে পরিবারকে অনেকটা ফাঁকি দিয়েই বাসা থেকে বের হতাম। কারণ ওই সময় সবার মধ্যে ছিল ভয়-আতঙ্ক। মোহাম্মদপুর বাসা হওয়ায় প্রতিদিনই বের হতে অনেক বেগ পেতে হতো। একদিকে পুলিশ, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ অন্যরা সাংবাদিকদের ওপরও হামলা চালাতো। জুলাইয়ের শেষের দিকে লাশ, আহাজারি আর গোলাগুলির ঘটনায় একপর্যায়ে ট্রমাটাইজড হয়ে যাই। পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়েছে।’
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ে দ্য মিরর এশিয়ার হেড অব নিউজ আসিফ শওকত কল্লোল বলেন, ‘দেশের মিডিয়া যখন শাটডাউনের কারণে সংবাদ প্রকাশ করতে পারেনি, তখন দেশের বাইরে থেকে আমাদের সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এতে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। খুব অনিশ্চিত সময়ের মধ্যে ছিলাম আমরা, মনে হচ্ছিল এ অবস্থা থেকে আর মুক্তি নাই। এর মাঝেই আমার সহকর্মীকে গোয়েন্দা সংস্থা তুলে নিয়ে যায়, এতে উদ্বেগ আরও বাড়ে। আমাদের নানাভাবে হুমকি দিতে থাকে, কবে তুলে নিয়ে যায় এটা নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়। তবু সংবাদ প্রকাশে অটল ছিলাম।’
আ. দৈ./ কাশেম