২০২০ সালে করোনা মহামারীর মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো জোড়াতালির এই লেখাপড়া। সে সময় দেড় বছর শ্রেণিকক্ষে সরাসরি পাঠদান বন্ধ থাকার পর স্কুল খুলে দেওয়া হয়। এরপর গেল দুই শিক্ষাবর্ষেও তীব্র দাবদাহ আর শৈত্যপ্রবাহের কারণে বন্ধ রাখতে হয়েছে স্কুল। সাথে যোগ হয়েছে গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান। জুলাই অভ্যুত্থান শেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতা নেওয়ার পর নতুন বছরের ইতিমধ্যে ২ মাস চলে গেল কিন্তু এখোনো ৬ কোটির বেশি বই সরবরাহ হয়নি।
মাধ্যমিকে ৩০ কোটি ৪০ লাখ বইয়ের মধ্যে সরবরাহ হয়েছে ২৪ কোটি ১৭ লাখ ৭২ হাজার।প্রাথমিকে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৬ বইয়ের মধ্যে সরবরাহ হয়েছে ৯ কোটি ৩ লাখ ৪৪ হাজার। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং এনসিটিবি শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব শিক্ষার্থী সব বই পাবে। তবে তাদের কার্যক্রম বললে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই দিতে কমপক্ষে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। বই পেতে যতই দেরি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতিও বাড়ছে।
এরই মধ্যে পবিত্র রমজান ও আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বিদ্যালয়গুলোতে ৪০ দিনের লম্বা ছুটি শুরু হয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের সব পাঠ্যবই হাতে পেতে অপেক্ষাও দীর্ঘ হচ্ছে। কারণ, বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সব বিদ্যালয়ে অবশিষ্ট বই সময়মতো দেওয়া যাবে কি না, সে প্রশ্নও আছে। এদিকে আগামী ১০ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ সময় দেশের বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে থাকবে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র। তাই ওই সময়ও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
কেন্দ্র থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টানা দুই মাস ১০ দিনের ছুটি কাটাবে। এসব দুর্যোগ-দুর্বিপাকে ও প্রসাশনিক অক্ষমতায় শ্রেণিকার্যক্রম বিঘ্ন হওয়ায় শিখন ঘাটতি রেখেই শেষ হচ্ছে শিক্ষাবর্ষ, শিক্ষার্থীরা উন্নীত হচ্ছে ওপরের শ্রেণিতে। ফলে শিক্ষার ভিত হয়ে যাচ্ছে খুবই নড়বড়ে। গেল কয়েক বছরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে মারাত্মক শিখন ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তা উঠে এসেছে বিভিন্ন সমীক্ষায়ও। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের তরফে সেই ঘাটতি পূরণের কোনো ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি।
শিক্ষা খাতের ক্ষতির প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ, বুয়েটের সাবেক ডিন, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, মানব সৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যে কোনো দুর্বিপাকে শুরুতে ক্ষতি হয় শিক্ষা খাত। এ দুর্যোগের প্রথম ক্ষতি হচ্ছে আমাদের শিক্ষা খাত। করোনা মহামারি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল, তা কাটিয়ে উঠছিলাম। কি›তু জুলাই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ঘাটতি এখোনো পূরণ হয়নি।
বিগত কয়েক বছরের ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়ে আসছে। প্রথমত, দেশে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রথম ধরা পড়ে, তখন সংক্রমণের কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এ অবস্থা প্রায় বছরদেড়েক ধরে চলে। এরপর বিগত দুই বছর ধরে তাপপ্রবাহ ও শৈতপ্রবাহের কারণেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিছুদিন বন্ধ থাকে। এরপর গত বছর শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। সেই সূত্র ধরে প্রায় একমাসের মতো বন্ধ থাক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এখানেই শেষ নয়। সরকার পতনের পরপরই শুরু হয় দক্ষিণাঞ্চলে বন্যা। যার কারণে বন্যাকবলিত এলাকগুলোতে বেশ কিছুদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকে। সরকার পতন ও বন্যার কারণে বারবার পেছানো হয় গতবছরের এইচএসসি পরীক্ষা। ফলে একই সাথে যেমন তাদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে তেমনি দীর্ঘায়িত হয় তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম।
এছাড়া সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে আগে থেকেই সেশন জটের স্বীকার সেখানে জুলাই আন্দোলনের কারণে এই সেশনজট আরো দীর্ঘায়িত হয়। কিছু কিছু ডিপার্টমেন্ট সেশন জট কমাতে তাদের সেমিস্টারের দৈর্ঘ কমিয়ে আনে। তবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য কতোটা ফলপ্রসু তা নিয়ে সন্দীহান বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে শিক্ষার এইসকল ঘাটতি পূরণে কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেই প্রসাশনের। শিক্ষাপ্রতি®ঠানের এই সেশনজট বা শিক্ষার্থীদের বইয়ের বিষয়ে কোন কার্যকর কর্মপরিকল্পনা নেই তাদের। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যাপক (শিক্ষা) ও সাবেক অধ্যক্ষ মো. মুজিবুর রহমান বলেন, এ পরিস্থিতিতে দেশ গঠনের পাশাপাশি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে গুরুত্ব দিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। প্রয়োজনে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সহযোগিতা কামনায় তাদের নিয়ে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা যেতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের সঙ্গে স্বল্প পরিসরে মতবিনিময় সভা আয়োজনের উদ্যোগ নিতে হবে।
এটি হতে পারে শ্রেণিভিত্তিক অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্ট শ্রেণিশিক্ষকের উপস্থিতিতে মতবিনিময় সভা। এ ধরনের সভা আয়োজনের লক্ষ্যে পৃথক পৃথক শ্রেণির জন্য পৃথক পৃথক দিবস নির্ধারণ করা যেতে পারে। তবে অনলাইনেও মতবিনিময় সভা করা যেতে পারে।
এতে আশা করা যায়, স্কুলগুলো আগের মতো শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে আনন্দমুখর ও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে আগে। এক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশনা স্কুলগুলোর কার্যক্রমে গতি বাড়াবে, সন্দেহ নেই।
আ.দৈ/আরএস