বায়ু দুষণের প্রভাবে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৫,২৫৮ শিশুসহ ১,০২,৪৫৬ জন মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া বায়ু দূষণের কারণে হার্ট ডিজিস, স্ট্রোক, হাপানি-শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ও ফুসফুস ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধীতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি এন্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) এর নতুন এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সিআরইএ এর গবেষণা বলছে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দুষিত দেশের তালিকায় স্থান পায়। যেখানে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বালু কণার বার্ষিক মান (পিএম ২.৫) ৭৯.৯ মাইক্রোগ্রাম। যা বার্ষিক জাতীয় মানদণ্ড ৩৫ মাইক্রোগ্রামের দ্বিগুণের বেশি। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড ৫ মাইক্রোগ্রামের ১৫ গুণ বেশি। বায়ুর এমন চরম দুষণ জনস্বাস্থ্যের ওপর অনিবার্য পরিণতি ডেকে আনছে। বিভিন্ন বয়সীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হবার পাশাপাশি ৫ বছর কম বয়সী শিশুদের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।
গুরুত্বপূর্ণ এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য CREA ও Center for Atmospheric Pollution Studies (CAPS) আজ শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে “বাংলাদেশে সূক্ষ্মকণা বায়ু দূষণে জনস্বাস্থ্য প্রভাব” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসময় ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য প্রধান শহরগুলোতে বায়ু দূষণের ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়। যা কার্যকর রাষ্ট্রীয় নীতিমালার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। পাশাপাশি, একটি ইন্টারেক্টিভ ড্যাশবোর্ড চালু করা হয়, যা সকল অংশীজনদের শহর ও জেলার ভিত্তিতে রিয়েল-টাইম দূষণের তথ্য এবং এর সাথে সম্পর্কিত স্বাস্থ্যের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ প্রদান করে। যাতে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের প্রভাবে উদ্বেগজনক স্বাস্থ্য সংকটের মধ্যে, ২০২২ সালে সরকার প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ঘুলি কণার মান ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেয়। যা গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টির পাশাপাশি বায়ুর মান অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
সিআরইসিএ-এর বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় বায়ু মানের মানদণ্ড (৩৫ মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘনমিটার) পূরণ করা সম্ভব হলে তা বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এতে মৃত্যুহার ১৯% হ্রাস, আয়ুষ্কাল জনিত সমস্যা (ওয়াইএলএল) ২১% এবং অক্ষমতার সাথে বসবাস করা বছর (ওয়াইএলডি) ১২% হ্রাস করতে পারে।
এছাড়া ডব্লিউএইচও-এর ২০২১ সালের কঠোর নির্দেশিকা বায়ুর মান প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা সম্ভব হলে মৃত্যুহার ৭৯% হ্রাস পাবে। যা প্রতি বছর ৮১,২৮২ মানুষের জীবন রক্ষা করবে। সেইসাথে হাপানি-শ্বাসকষ্ট প্রায় সমস্ত জরুরী চিকিসক ভিজিট, অকাল প্রসব এবং বার্ষিক ২৬৩ মিলিয়ন অসুস্থতাজনিত ছুটি এড়ানো যাবে।
এটি লক্ষ্যণীয় যে বাংলাদেশে পিএম২.৫-এর সংস্পর্শের প্রভাবে উল্লেখযোগ্য রোগবালাই হয়, আনুমানিক: হাঁপানির কারণে বার্ষিক ৬,৭০,০০০ রোগী জরুরি বিভাগে ভর্তি হয়ে বার্ষিক ২৬৩ মিলিয়ন কর্মদিবস হারিয়েছে। ৯,০০,০০০ অকাল প্রসব এবং বার্ষিক ৭০০,০০০ কম ওজনের শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এসব স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে বিরাট অর্থনৈতিক ব্যয় জড়িত। যার মধ্যে উচ্চতর স্বাস্থ্যসেবা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে সার্বিকভাবে এই ব্যয়গুলি ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল। যা বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৫%।
নীতি সুপারিশ:
বাংলাদেশকে নিজস্ব জাতীয় নির্দেশিকা মেনে চলার পাশাপাশি তা প্রয়োগ করতে হবে। মাঝারি মেয়াদে ২০০৫ সালে ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১০ মাইক্রোগ্রাম এর দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হিসাবে ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও নির্দেশিকা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রাম অর্জন করা উচিত.
কয়লা ও ডিজেলের মত কার্বণ নিঃসরণকারী জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসাহিত করা উচিত। এছাড়া ক্লিন পরিবহন ব্যবস্থা ও শিল্প সম্প্রসারণ দীর্ঘমেয়াদে পিএম ২.৫ নিয়ন্ত্রণে রাখতে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
শিল্পখাতে নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ: কঠোর শিল্প নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যানবাহন এবং কলকারখানার নির্গমন মান বাড়াতে হবে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো শহরগুলোতে ধাপে ধাপে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। ফলাফল নিশ্চিতের জন্য অধীক দুষণকারী শিল্প যেমন ইট ভাটা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।
মনিটরিং নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ: ভূমিভিত্তিক এবং স্যাটেলাইট ডেটা একত্রিত করে জাতীয় পর্যবেক্ষণ কাঠামো তৈরি করতে হবে, যা PM2.5-এর প্রবণতা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকি নির্ধারণে সহায়ক হবে।
সিআরইএ এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান বলেছেন, "সিআরইএ-এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিভিন্ন বায়ু মানের মানদণ্ড, বাংলাদেশের বর্তমান মান এবং ২০০৫ ও ২০২১ সালের ডব্লিউএইচও এর নির্দেশিকা তুলনা করে দেখা গেছে যে, পিএম ২.৫ স্তরে সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য সুবিধা এনে দিতে পারে। কঠোর নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি গ্রহণের মাধ্যমে বায়ু দূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব"।
সিআরইএ এর বায়ু মান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি বলেন, "বাংলাদেশের বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার অপরিণত শিশু, কম ওজনের শিশুর জন্ম এবং শিশু মৃত্যু ঘটছে। এই পরিস্থিতি এমন হস্তক্ষেপের জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা সবচেয়ে অরক্ষিতদের সুরক্ষা দিতে সক্ষম। PM2.5 দূষণ প্রতি বছর প্রায় ২৬৬ মিলিয়ন কর্মদিবসের ক্ষতি সৃষ্টি করে, যা উৎপাদনশীলতার বড় ধরনের ক্ষতি করে ব্যবসা ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করে দেয়। বাংলাদেশের বায়ু দূষণ সমস্যার সমাধান জনস্বাস্থ্য এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে বিনিয়োগের সমতুল্য,"
ক্যাপস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি শুধু মানবদেহকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই, এ মুহূর্ত থেকেই দূষণ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ এবং নীতিমালা গ্রহণ করা না হলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বায়ুদূষণের কারণে গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে।
সুইডিশ দূতাবাস বাংলাদেশ-এর ফার্স্ট সেক্রেটারি (পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন) মিসেস নায়োকা মার্টিনেজ –ব্যাকস্ট্রম বলেন, বায়ুদূষণ ঢাকা এবং বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রাধিকারমূলক পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে পরিষ্কার উৎপাদন ব্যবস্থা, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নীতিমালা ও প্রণোদনা তৈরি, কার্যকর গণপরিবহন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ। সুইডিশ সরকার অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অংশীদারদের সাথে মিলে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন- সামাজিক নিরাপত্তা জাল, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণসহ নানাক্ষেত্রে সক্রিয়ভাবে সহায়তা প্রদান করছে এবং বাংলাদেশে গুরুতর বায়ুদূষণ হ্রাসে আরও সহযোগিতার আশা করছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দুষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ) তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, পিএম ২.৫ বাংলাদশে নি:সন্দেহ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বায়ু দূষণ কমাতে সরকার সর্বোচ্চ সামর্থ্য দিয়ে কাজ করছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন দর্শনে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এ জন্য আইন সংস্কারসহ এর কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। প্রেস কনফারেন্সে আরও বক্তব্য দেন, সেন্টার ফর ল এন্ড পলিসি অ্যাফেয়ার্সের সেক্রেটারি সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন, ২৫০ শয্যা টিভি হাসপাতালের উপ পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক মাহবুবুল ইসলাম।
আ, দৈ./ কাশেম