সরকার যায়, সরকার আসে। কেবল বদলায় না দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা। টেকসই কোন নীতিমালা না থাকায় ব্যবসায়ীদের নানা ছলচাতুরির কবলে নাজেহাল হতে হয় সাধারণ ভোক্তাদের। প্রাকৃতিক নিয়মে মৌসুমী কৃষি উৎপাদন ভালো হলে ক্ষণিকের স্বস্তি মেলে সাধারণ ক্রেতার। বাকি দিনগুলোতে বাজারের ঘানি টানতে ওষ্ঠাগত নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। কেবলই কী রাজনৈতিক মদদপুষ্ট সিন্ডিকেটের দাপটে বাজারের এই করুণ হাল? নাকি বছরের পর বছর ধরে বাজার মাফিয়াদের এই কারসাজি চলবে! স্বল্প জনবলের ভোক্তা অধিদপ্তর মাঝেমধ্যে বাজারে নামলেও তার প্রভাব পড়ে না মূল্য নিয়ন্ত্রণে। জনসাধারণের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্যের বাজার সরকারের কাছে যেন অপ্রয়োজনীয়ই রয়ে গেছে। সব সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সংগ্রাম থাকলেও ক্রেতা সাধারণ যেন বোবা প্রাণী। ব্যাগ হাতে বাজারে হেঁেট যাওয়া আর চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল পণ্য নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসাই যেন তাদের নিয়তি।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক দলগুলো যেমন স্বস্তি পেয়েছে, সাধারণ মানুষও তেমনি স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। তবে সাধারণ মানুষের স্বস্তি প্রকাশের পেছনে অন্যতম যে প্রত্যাশা ছিল তা হলো, নতুন সরকার নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনবে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস ওঠা মানুষ কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাবে। কিন্তু বাস্তবে সাধারণ মানুষের সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা উন্নতির দিকে থাকলেও নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিতিশীলতা সমাজের এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের অপ্রাপ্যতা এবং মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার বাড়িয়ে তুলছে। বস্তুত সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পেয়েও বর্তমান সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো সফলতা দেখাতে পারছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে যেমন নাকাল ছিল, এখনো প্রায় তেমনই আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। এর কারণ খতিয়ে দেখাও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। ছাত্র-জনতার অভুত্থানে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যাবার অন্যতম কারণ ছিল, বাজারে পণ্যমূল্যের উর্ধ্বগতি রোধ করতে না পারা। কারণ ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে কিন্তু বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়েই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতিকে বড় দুটি অগ্রাধিকার ঘোষণা করে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে অনেক প্রতিশ্রুতি ও অভিযানের পরও পবিত্র রমজানেও ক্রেতারা নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে রেহাই পাননি। নিত্যপ্যণের বাড়তি দাম তাদের জীবনকে আরো কঠিন করে দিয়েছে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ মাস পর কিছুটা কমে আসে। তবে তা খুব সামান্যই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বিবিএসের তথ্য-উপাত্তে দেখা যাচ্ছে, মার্চে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ; মার্চে যা কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯৩ শতাংশে। ফেব্রুয়ারিতে দেশে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ; মার্চে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭০ শতাংশ। বেসরকারি চাকরিজীবি মো. রহিম উদ্দিন শেখ নামের একজন ক্রেতা বলেন, মৌসুমের সময়ে পণ্যের দাম কম থাকলেও মৌসুম শেস হয়ে যাওয়ার আগেই পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। রমজানে যেমন পেঁয়াজের মৌসুম ছিল, তাই দাম কিছুটা সহনীয় ছিল। কিন্তু মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই অসাধু ব্যবসায়ীরা গুদামজাত করে ফেলেছে। আর তাই দামও বাড়ছে হু হু করে। চালের বাজারও একই অবস্থা। তেলের দাম ১৪ টাকা বাড়িয়ে দেয়ার পরেও বাজারে মিলছে না। এর কারণ সিন্ডিকেট করে আরো দাম বাড়ানোর পায়তারা।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। এনবিআরও তেল, আলু, পেঁয়াজ, ডিমসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক-কর কমিয়ে দেয়। বাজারে নিত্যপণ্যের আমদানিপ্রবাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করা হয়। বাজার ব্যবস্থাপনায় অন্তর্বর্তী সরকার অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেছে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সেক্রেটারি নাজের হোসেইন বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডার মধ্যে বাজার সংস্কার কমিটি নেই। তিনি বলেন, আমরা বার বার নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার সংস্কার কমিটি গঠন করার কথা জানালেও জানালেও কী এক অদৃশ্য কারণে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ধানের বাজারের নিয়ন্ত্রণ করপোরেট ব্যবসায়ীদের হাতে থাকায় ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়তি। অতি মুনাফার মনোভাবের কারণেই আলু ও পেঁয়াজের বাজার চড়া। ভ্যাট কমালেও তার প্রভাব ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। এসব কারণেই কমিশন গঠন অত্যন্ত জরুরি। তিনি আরো বলেন, ব্যবসা বাণিজ্য সব ওই আমলে যাদের হাতে ছিল, এখন শুধু হাত বদল হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট ভাঙেনি। বহুরকম কমিশন হয়েছে, বাজার নিয়ে কোনো কমিশন কিন্তু এখনো হয়নি। আমরা ক্যাবের পক্ষ থেকে এই দাবিটি করছি যে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য একটা কমিশন করেন।
তিনি বলেন, আমরা যারা ভোক্তাÑ তারা বাজার থেকে পণ্য বেশি দামে কিনছি, আবার কৃষক যিনি উৎপাদন করছেন, তিনি কম দামে বিক্রি করছেন। আমরা দীর্ঘদিন থেকেই দেখে আসছি যে, পণ্য হাতবদল হলেই দাম বাড়ে। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য আমরা কৃষকের কাছাকাছি হাটের বিষয়ে বলেছিলাম। কৃষক যদি সরাসরি বিক্রি করার সুযোগ পায়, হাতবদল যদি কমানো যায়Ñ তাহলে হয়তো কিছুটা উপকার পাওয়া যেতে পারে। আবার বগুড়া বা রংপুর, অর্থাৎ যেখান থেকে আমাদের সবজি বেশি উৎপাদন হয়, সেখান থেকে যেন কৃষকরা বুলেট ট্রেণের মাধ্যমে ঢাকায় পণ্যগুলো আনতে পারে। তাহলে কৃষকের ভোগান্তি কমবে, চাঁদাবাজি কমবে। নাজের হোসেইন আরো বলেন, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের আরো কিছু সংরক্ষণাগার তৈরি করা প্রয়োজন। কৃষকরা উৎপাদন খরচ তুলতে দাদন দিয়ে পণ্য বিক্রি করে ফেলে। তাই আগে কৃষককে ঋণ সাপোর্ট দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে বলেও জানান তিনি।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক পরিবার তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না। ঈদের সময়টায় পণ্যের বাজার ভালো থাকলেও পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেলের বাজার আবারো অস্থির হয়ে পড়েছে। সরকার নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৮৯ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকায়। সয়াবিনের বিকল্প পামতেলের দাম লিটারপ্রতি ১৬৯ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকায় কিংবা আরও বেশিতে। একইভাবে পেঁয়াজের দামও অস্বাভাবিক বেড়েছে।
চারদিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা। বেড়েছে সবজির দামও। ভোজ্যতেলের আমদানিকারকরা বলছেন, কর ও ভ্যাটের কারণেই বেড়েছে দাম। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি সিন্ডিকেটের হাতে ভোজ্যতেলের বাজার জিম্মি হয়ে পড়েছে। চক্রটি ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। পাইকারি থেকে খুচরা, কোথাও মিলছে না ভোজ্যতেল। এটা এক বড় প্রশ্ন, রমজানে পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও এখন কেন আবার বেড়েছে? রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখার প্রশ্নে সরকার কঠোর অবস্থানে ছিল বলে সিন্ডিকেটগুলো সেভাবে সক্রিয় হতে পারেনি। তবে ঈদের পরে বাজার মনিটরিংয়ে শৈথিল্য দেখিয়েছে বলে মনে করেন সাধারণ ক্রেতারা। এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিভিন্ন পণ্যের সিন্ডিকেটগুলো স্থায়ীভাবে ঠিক হওয়ার নয়। সুযোগ পেলেই তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ সিন্ডিকেটগুলো দীর্ঘকাল থেকে অতিরিক্ত মুনাফার লোভে পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তা শ্রেণিকে দুর্ভোগে ফেলে।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান এ বিষয়ে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর অনেকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে দেশের সাধারণ মানুষ। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমছে। তিনি আরো বলেন, সিন্ডিকেট সাধারণত সবজির ক্ষেত্রে কার্যকর থাকে না। কারণ সবজি পচনশীল। তবে চাল, তেল, ডাল, আলু পেঁয়াজের ক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হয়। তিনি বলেন, সরকার শুধু সিন্ডিকেট ভাঙবো বলে বসে থাকলে হবে না। সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে সরকারকে বাজারে ঢুকতে হবে। সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য বাজারে প্রচুর পরিমানে পণ্য সরবরাহ বাড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে যে ৫-৬ কোম্পানি বাজারে সিন্ডিকেট করছে তারা আর সাহস করবে না।
ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ফসলের চক্রটা হচ্ছে এমন যে আমরা শীতকালীণ সবজির উপরেই নির্ভর করি বেশি। কারণ শীতকালে সবজির উৎপাদন ভালো হয়। কিন্তু উৎপাদন ভালো হলেই দাম পড়ে যায়। সমস্যা হচ্ছে আমাদের ফেসিলিটি কম। উৎপাদন মৌসুমে দাম কমে যাবেÑ এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক বেশি দাম পড়ে যায়, যা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এজন্য প্রয়োজন ছিল সংরক্ষণ ফেসিলিটি বাড়ানো। কিন্তু তা হয়নি।