২১ জুলাই ২০২৫। দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে আরেকটি শোকাবহ অধ্যায় হিসেবে যুক্ত হলো। রাজধানী ঢাকার উত্তরা এলাকায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অন্তত ৩৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই শিশু। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি চীনা নির্মিত প্রশিক্ষণ বিমান এফ-৭ বিজিআই বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে।
এই ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং এটি দেশের বিমান নিরাপত্তা, নগর ব্যবস্থাপনা এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার একটি নগ্ন উদাহরণ হয়ে উঠেছে।
ঘটনার বিবরণ ২১ জুলাই ২০২৫, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা, ঢাকা এফ-৭ বিজিআই রুটিন প্রশিক্ষণ মিশনে নিয়োজিত
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম উড্ডয়নের পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হয় বিমানটি এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই এটি মাইলস্টোন স্কুলের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার সাথে সাথেই স্কুল ভবনে ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে। এতে মোট নিহত কমপক্ষে ৩৫, শিশু (১২ বছরের নিচে) প্রায় ১৮ জন, আহত ৫০+, নিহত পাইলট তৌকির ইসলাম (মৃত্যুর আগে নিরাপদ ল্যান্ডিংয়ের চেষ্টা করেছিলেন),স্কুল ভবনের একাধিক ব্লক পুড়ে ছাই।
এফ-৭ বিজিআই বিমান: কতটা নিরাপদ?
এফ-৭ বিজিআই বিমানটি মূলত চীনের চেংদু এয়ারক্রাফট করপোরেশন -এর তৈরি, যা মূলত সোভিয়েত মিগ ২১-এর কপি। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী এই বিমানগুলো ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে সংগ্রহ করে। তবে সামরিক বিশেষজ্ঞরা বারবার এই মডেলের outdated avionics, poor maintenance compatibility, and frequent technical issues নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
বিশ্লেষণ: বিমানটির গড় আয়ুষ্কাল প্রায় ২৫ বছর হলেও, বাংলাদেশে ব্যবহৃত অনেকগুলোই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে।
এই মডেলে পাইলটদের জন্য zero-zero ejection seat নেই, যা অনেক উন্নত দেশে থাকা বাধ্যতামূলক।প্রতিক্রিয়া: রাষ্ট্র, নাগরিক ও অভিভাবকদের ক্ষোভ, ঘটনার পরপরই প্রধান উপদেষ্টা গভীর শোক প্রকাশ করেন।তবে এতে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি।
কেন এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত?
১. অপ্রতুল রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা: বিমানটির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ‘Time Before Overhaul (TBO) শেষ হলেও ফ্লাইটে রাখা হয়েছিল।
২.নিয়ন্ত্রণহীন প্রশিক্ষণ এলাকা নির্বাচন: প্রশিক্ষণ রুটের মধ্যে ঘনবসতি ও স্কুল এলাকা থাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুঁকি ছিল। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রশিক্ষণ বিমানকে ‘নিরাপদ দূরত্বে’ পরিচালনার নিয়ম রয়েছে।
ভবিষ্যৎ প্রতিরোধে করণীয়
১. পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ বিমান বাতিল করা:
এফ-৭ বিজিআই, মিগ ২১ধরনের পুরনো যুদ্ধবিমানগুলো ধাপে ধাপে অবসর দিতে হবে।
২. শহরের ভিতর ‘নো-ফ্লাই জোন’ চালু:
বিশেষ করে স্কুল, হাসপাতাল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
৩. মানবিক ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ:
ফ্লাইট ক্রুদের নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং stress-simulation প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে।
৪. স্বচ্ছ তদন্ত ও তথ্য প্রকাশ:
সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করে তদন্ত পরিচালনা করতে হবে। প্রতিবেদন প্রকাশে গোপনীয়তা নয়, গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা চাই।
৫. ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের জন্য রাষ্ট্রীয় পুনর্বাসন প্যাকেজ:
নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত আর্থিক সহায়তা, সন্তানহারা পরিবারে মনোসামাজিক কাউন্সেলিং ও চাকরির নিশ্চয়তা দেওয়া প্রয়োজন।
শেষ কথা মাইলস্টোন দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমরা কতটা অনিরাপদ এক নগরে বেঁচে আছি। একটি রাষ্ট্র তখনই সভ্য হয়, যখন শিশুদের প্রাণ রক্ষায় সে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়। আমরা আর একটি মৃত্যু চাই না। আমরা আর একটি ‘মাইলস্টোন’ চাই না। আজ যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা চাই ব্যবস্থা বদলাক, জবাবদিহিতা আসুক, এবং নিরাপত্তার সংস্কার হোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট