অদূর ভবিষ্যতে ঠিক কী রকমের ‘শাসন’ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর বিপ্লবের পর এ দেশের জনগণ তাদের স্বার্থবিরোধী দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী অপশাসন ব্যবস্থার ভোগান্তি নতুন করে আনতে চাইবে না নিশ্চয়ই।
পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকার কয়েকটি কু-যুক্তির একটি ছিল উন্নয়নের গালভরা বয়ান।
বাস্তবে ওই সময় জনগণের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠনকারী ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি অভিজাত শ্রেণি তৈরি করা হয়। দেশে বৈষম্য বাড়া এবং মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে জাতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত করা ও বিদেশে অর্থ পাচারের অসংখ্য প্রতিবেদন আমরা দেখছি। এগুলো কোনো মহৎ অর্থনৈতিক নীতির নমুনা দেখায় না।
হাসিনা প্রশাসন এবং তাঁর রাজনৈতিক সাঙ্গপাঙ্গরা টাকা-পয়সার গতি এমনভাবে নির্ধারণ করেছে, যাতে এলিটদের হাতেই আরও টাকা আসে। এতে মধ্যবিত্তের পর্যন্ত নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে কষ্ট পাওয়ার কথা, তা-ই পেয়েছে।
সাধারণ মানুষের জন্য দেশের ভেতরে সুযোগ কমে যাওয়ায় আমরা দেখেছি বিদেশমুখী বাংলাদেশিদের মিছিল। করোনাকালে এবং পরবর্তী স্বাভাবিক সময়েও কয়েক কোটি মানুষ নতুন দরিদ্র হিসেবে অধঃপতিত হয়েছে।
উন্নয়নের নামে যখন এ দেশের জনগণ ভোটাধিকার ও অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, সেই অধিকারহীন পরিবেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নও তাদের ফাঁকি দেয়।
আমজনতা শেষ পর্যন্ত সব বিষয়েই প্রতারিত বোধ করে এবং তাদের উন্নয়নের ঘাস খাইয়ে ভেড়া বানানোর ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খুলে পড়ে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে যোগদান করে সাধারণ মানুষ তাদের উন্নয়নের প্রত্যাশার জানান দেয়।
পুরোনো শাসনব্যবস্থায় জনগণ যেখানে ছিল প্রতারণার শিকার; তারাই বিপ্লবের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেয়। তবু হাসিনার উন্নয়নের বন্দোবস্ত কেমন ছিল, তা কি ভোলা যায়?
সীমাহীন দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি, স্বজনপ্রীতি, অবৈধ কমিশন, সরকারি সম্পত্তি দখল ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার, টেন্ডার ও ঋণ জালিয়াতি, পুঁজিবাজার লুণ্ঠন, ভূমি গ্রাস, অর্থ পাচার, অভিজাত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, অযোগ্য লোকদের নিয়োগ, প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং সরকারি কেনাকাটায় জোচ্চুরি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতিই ছিল বিগত আর্থ-রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের অবজ্ঞার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে গণ-আস্থা ছিল অনুপস্থিত।
হাসিনার ধামাধরা পুঁজিবাদের উপকারভোগীরা ছাড়া সব মানুষ অবশ্যই ওই অর্থনৈতিক দুরাচার থেকে মুক্তি চাইত। তাঁর চামচারা অর্থনৈতিক অবিচারকে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গভীরে নিয়ে যায় এবং এটা অনেকের সংস্কৃতি ও মানসিকতার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সেটাকেই প্রত্যাখ্যান করেছে বিপ্লব।
ভেঙে ফেলা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার উচ্ছিষ্টসমূহ অপসারণ করা এবং সম্পূর্ণ নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা মোটেও সহজ কাজ হবে না। সংস্কার কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা এবং যোগ্য ও সঠিক মানুষকে যথাযথ জায়গায় বসানো এ দেশে খুবই দুষ্কর ব্যাপার।
ভুলে যাবেন না, যারা অবৈধ অর্থ-সম্পদ দখল করে আছে দীর্ঘদিন ধরে, তাদের পক্ষে নাশকতা করা খুব কঠিন কাজ নয়। ভুলে যাবেন না, হাসিনা আমলের সেসব অর্থ-সম্পদ এখনো উদ্ধার হয়নি।
এ দেশের মানুষ ভবিষ্যতে তাদের প্রাপ্য অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ও ন্যায়বিচার পাবে কি না, তা নির্ভর করবে কে ক্ষমতার নিয়ামক হবে, তার ওপর। ক্ষমতার নিয়ামক জনগণের রাজনৈতিক প্রতিনিধি নাকি বিশেষ সুবিধাভোগী অভিজাত গোষ্ঠী হবে, তার ওপর এসব নির্ভর করবে।
অভিজাততন্ত্র জনগণকে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করবে, তা নতুন করে বলার কিছু নেই। অন্যদিকে সব ব্যবসার নির্ধারক হিসেবে রাজনীতি কিন্তু সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করতে পারে।
বিপ্লবের আওয়াজে মানুষের যে না-বলা প্রত্যাশা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, তা অবশ্য রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে লিখিত-পঠিত হয়নি। কারণ ৫ আগস্ট, যেদিন বৈষম্যমূলক শাসনের ইতি টেনে নবযুগের অঙ্গীকার করা হয়, সেদিন বিপ্লবের ইশতেহার ঘোষণা করা হয়নি।
তাই চলমান ও আগামী পরিবর্তনের লক্ষ্যে রাষ্ট্র এবং সচেতন নাগরিকদের কাজ হচ্ছে জনগণের জানা-অজানা প্রত্যাশা, দাবি ও প্রয়োজনসমূহ তালিকাভুক্ত করা।
মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এবং অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র মেরামত ও জনগণের সেবা পাওয়ার মান উন্নত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আশঙ্কার কথা, অনেক মানুষ দ্রুতই ধৈর্য হারিয়ে ফেলতে পারে; যদি না শিগগিরই তাদের জীবন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থায় পরিবর্তন আসে। এর দায়িত্ব বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত জন-আকাঙ্ক্ষাকে আইনগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং রাজনৈতিক রূপ প্রদানে নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের।
যেহেতু আন্দোলনের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন সত্ত্বেও কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে বিপ্লব সংঘটিত হয়নি, সেহেতু এ মুহূর্তে আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জনগণের এজেন্ডার রাজনৈতিক মালিকানা।
এখন ক্ষমতার দাবিদার রাজনৈতিক দলের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জন-আকাঙ্ক্ষাকে তাদের কর্মসূচিতে ধারণ করা। ফ্যাসিবাদ উৎখাতের ফলে কাজের নতুন দিগন্ত তাদের সামনে।
বিপ্লবের প্রক্রিয়া শুরুই হয়েছিল সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবি দিয়ে। সুতরাং সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের চাওয়া হলো ইনসাফ, ন্যায়নিষ্ঠতা, সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, সমতা এবং মানবিক মর্যাদা।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের প্রাপ্য এমন একটি পরিবেশ, যেখানে ব্যক্তি ও সমবেত মানুষ বড় হতে পারবে এবং নাগরিকদের অসহায় দশায় পড়তে হবে না। জাতীয় অগ্রগতি ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে প্রধান বাহন হবে মানসম্মত শিক্ষা।
জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণে অর্থনৈতিক এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে মেধা অন্বেষণ, শিক্ষা ও গবেষণায় অধিক বিনিয়োগ, উদ্যোক্তা তৈরি, দুর্নীতিমুক্ত সরকারি কার্যক্রম ও সেবা, ব্যবসায় সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা, কর সংস্কার, সরকারি কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিদের আয়-ব্যয়ের প্রকাশ্য হিসাব, স্বাস্থ্যসেবা ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনা, বাসযোগ্য নগর নির্মাণ এবং আবাদি জমি ও পরিবেশ রক্ষা।
বিপ্লব ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনায় বর্তমান সরকার একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে দায়িত্ব পালন করছে। এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক নীতি ও বিধি-বিধান প্রণয়ন, আইন সংস্কার এবং প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণ।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে অর্থনীতির পণ্ডিতদের রাজনৈতিক গতিধারা ও মতাদর্শ বিষয়ে এবং রাজনীতিকদের অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আগ্রহের ঘাটতি দেখা যায়।
সুতরাং, ভবিষ্যতে যারা সংসদে বা ক্ষমতায় যেতে আগ্রহী অথবা কেউ যদি অ্যাকটিভিস্ট হিসেবেও সফল ভূমিকা রাখতে চান, তাঁদের অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার হবে।
মাফিয়াতন্ত্রের পুনরুত্থান ঠেকানো এবং বিপ্লবের প্রত্যাশা মেটাতে রাজনৈতিক প্রস্তুতি থাকতে হবে।
লেখক: খাজা মাঈন উদ্দিন, সাংবাদিক