বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হিসেবে দায়িত্বরত চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেছেন, গতবছর ২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলন দমন প্রসঙ্গে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হাসিনার নির্দেশেই আন্দোলনে মারণাস্ত্রের ব্যবহার হয়। ছাত্র জনতার আন্দোলন দমানোর জন্য সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ কার কী ভূমিকা, তা তুলে ধরেন। তার জবানবন্দিতে উঠে আসে আন্দোলনের সময়কার নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।
উল্লেখ্য,গত ২৪ মার্চ ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইনের আদালতে ‘বিবেকের তাড়নায়’ স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দাবি করেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। বিচারক জবানবন্দি নেওয়ার আগে তাকে ভাবতে আড়াই ঘণ্টা সময় দেন।
জবানবন্দিতে সাবেক আইজিপি মামুন বলেন, আন্দোলন দমনের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় ১৯ জুলাই থেকে প্রায় প্রতিদিন রাত ৮টা থেকে ৯টার দিকে নিয়মিত কোর কমিটির মিটিং হতো। আমি কোর কমিটির সদস্য ছিলাম।
সেখানে সচিব জাহাঙ্গীর, অতিরিক্ত সচিব টিপু সুলতান, রেজা মোস্তাফা, এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ, র্যাবের ডিজি হারুনুর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, বিজিবির ডিজি মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসারের ডিজি মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, এনটিএমসির ডিজি মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান ও ডিজিএফআই প্রধান উপস্থিত থাকতেন।
আইজিপি মামুন আরও বলেন, কোর কমিটির একটি বৈঠকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের আটকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। আমি এর বিরোধিতা করি। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের আটক করা হয়। ডিবির হারুনের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গভীর সম্পর্ক ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হারুনকে ‘জিন’ নামে ডাকতেন। তিনি হারুনকে খুব কর্মতৎপর এবং সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে খুব কার্যকর মনে করতেন। আন্দোলন দমনের উদ্দেশে এক পর্যায়ে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে নজরদারি, গুলি ও ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির জন্য গোপন পরিকল্পনা করা হয়। তবে পুলিশ প্রধান হিসেবে আমি ওই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না।
মামুন তার জবানবন্দিতে বলেন, আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার এবং আন্দোলনপ্রবণ এলাকায় ব্লক রেইডের সিদ্ধান্তও হয় রাজনৈতিকভাবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে আমাকে জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলন দমন করার জন্য লেথাল উইপেন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় আমার সম্মুখে অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় জোয়ার্দ্দার উপস্থিত ছিলেন। ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও ডিবি প্রধান হারুনুর রশিদ লেথাল উইপেন ব্যবহারে অতি উৎসাহী ছিলেন।
এরপর ১৮ জুলাই ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রকাশ্যে চাইনিজ রাইফেল ব্যবহার করে গুলির নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, মেয়র ফজলে নূর তাপস, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, ওবায়দুল কাদের, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, হাসানুল হক ইনু এবং রাশেদ খান মেনন মারণাস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে নির্মূল করার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতেন।
৫ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টায় সরকারের পতন হয়:
সাবেক আইজিপি বলেন, ৪ আগস্ট বেলা ১১টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়। সেখানে আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান এবং আমিসহ নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। গোয়েন্দা প্রতিবেদন জানায় যে, আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন। ওই মিটিংয়ে থাকাবস্থায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। পরে বৈঠক মুলতবি করা হয়।
পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ৪ আগস্ট রাত ১০টায় হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী গণভবনে বৈঠক ডাকেন। কীভাবে ৫ আগস্টের গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয়।
প্রায় ৩০ মিনিট বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, মেজর জেনারেল মুজিব, ডিজি র্যাব, গোয়েন্দা বাহিনী, ডিএমপি কমিশনার ও আমি নিজে ছিলাম। সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। বৈঠক রাত সাড়ে ১২টার দিকে শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন ৫ আগস্ট সকাল ১০টা পর্যন্ত ঢাকার ভেতরে আমাদের পুলিশের শক্ত অবস্থান ছিল।
ঢাকার প্রবেশমুখে উত্তরা-যাত্রাবাড়ী এলাকায় লাখ লাখ মানুষ জড়ো হয়। আমি তখন পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অবস্থান করি। ডিএমপি কমিশনারসহ ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ অফিসাররা কন্ট্রোল রুমে ছিলেন। সেখান থেকে তারা নির্দেশনা দেন। বেলা ১১টার দিকে উত্তরা থেকে লাখ লাখ লোক ঢাকার ভেতরে আসতে শুরু করেন।
তখন জানতে পারি, সেনাবাহিনী জনতাকে বাধা দেয়নি। সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের অফিসার ও ফোর্স আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। এর ফলে জনগণের গণভবনমুখী জনস্রোতকে আটকানো সম্ভব হয়নি। আমি দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টার মধ্যে বুঝতে পারি, সরকার পতন হবে, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। এটা আমি এসবির মাধ্যমে জানতে পারি।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে গুম বা ক্রসফায়ারের নির্দেশনা আসতো :
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে রাজনৈতিক ভিন্নমতাদর্শীদের গুম ও ক্রসফায়ারের নির্দেশনা আসতো বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন মামুন। এ কাজটি করতো র্যাব। মামুন বলেন, আমি ২০২০ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলাম। মহাপরিচালক থাকার কারণে আমি জানি, টিএফআই সেল র্যাবের সদর দপ্তরের অধীনে পরিচালিত হতো। এটির অবস্থান উত্তরার র্যাব-১-এর কম্পাউন্ডের ভেতরে।
এ ছাড়া র্যাবের বিভিন্ন ইউনিটের অধীনেও আলাদা সেল বা বন্দিশালা ছিল, যেগুলো সংশ্লিষ্ট র্যাব ইউনিটগুলোর প্রধানদের অধীনে পরিচালিত হতো। র্যাব কর্তৃক রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী এবং সরকারের জন্য হুমকি হয়ে ওঠা কোনো ব্যক্তিকে তুলে আনা, জিজ্ঞাসাবাদ, নির্যাতন এবং গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার বিষয়টি র্যাবের ভেতরে একটা কালচার হিসেবে বিবেচিত হতো।
তবে এ কাজগুলো প্রধানত র্যাবের এডিজি (অপারেশন) এবং গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকরা সমন্বয় করতেন। র্যাব কর্তৃক কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে আনা বা গুম করার নির্দেশনা বা ক্রসফায়ারে হত্যা করার মতো সিরিয়াস নির্দেশনাগুলো সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসতো বলে শুনেছি। আমার সময় আমি এ ধরনের আদেশ পাইনি। কিছু কিছু নির্দেশনা সামরিক উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিকের পক্ষ থেকে আসতো বলে জানতে পারি।
মামুন বলেন, র্যাবের আলেপ উদ্দিন ও মহিউদ্দিন ফারুকীকে আমি চিনতাম। আলেপ প্রথমে নারায়ণগঞ্জে র্যাবে ছিল। পরবর্তী সময়ে র্যাবের এডিজির (অপারেশন) প্রস্তাবে তাকে র্যাব ইন্টেলিজেন্সে পদায়ন করা হয়। গুমসহ বিভিন্ন অপেশাদার কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে আলেপের বিশেষ দক্ষতার জন্য তাকে র্যাবের অফিসাররা পছন্দ করতেন। পুলিশ অফিসারদের মধ্য থেকে সে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কাউকে উঠিয়ে আনা, গুম করে রাখার মতো বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক সরাসরি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতেন।
সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী পরামর্শে রাতের ভোট হয়: ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় আমি ডিআইজি ঢাকা রেঞ্জ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তৎকালীন আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে রাতের বেলায় ব্যালট বাক্সে ৫০ শতাংশের মতো রাখার পরামর্শ দেন বলে শুনেছি।
আ. দৈ./কাশেম