সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫,
১৫ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার

সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
মতামত
উপদেষ্টারা কি যাবেন না জেলে ও কৃষকদের কাছে?
নাহিদ হাসান
Publish: Friday, 20 December, 2024, 6:17 PM  (ভিজিট : 221)
প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশ তথা ভারতবর্ষের রাজনীতিতে জেলে-কৃষকেরাই নেতৃত্বে ছিলেন। ফকির মজনু শাহ, নূরলদীন, ভবানী পাঠক, দেবী চৌধুরানী, টিপু পাগলারা ছিলেন কৃষকনেতাই। এটি ছিল ব্রিটিশের অধীন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ তৈরি হওয়ার আগ পর্যন্ত। তারপর থেকে (শেরেবাংলা ও মাওলানা ভাসানী ছাড়া) যত পার্টি তৈরি হয়েছে, সবাই কৃষকবিরোধী ভূমিকা নিয়েছে। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে গ্রামের জেলে ও তাঁতির যেমন নেতৃত্ব ছিল, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে তা নেই। এই অভ্যুত্থানকে তাঁদের ঘরে নিয়ে যাওয়ার উপায় কী?


১. 
সেই ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা ছিল, ‘বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করে উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ এবং খাজনা হ্রাস ও সার্টিফিকেট মারফত খাজনা আদায় রহিত করা হবে।’
 
জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে সেই ১৯৫০ সালে। এখনো হাট-ঘাটে ১৯৫০ সালের আগের নিয়মটাই চালু আছে। খাজনা আদায়কারী স্বত্বগুলো উচ্ছেদ এখনো হয়নি। 

সরকারের কাছ থেকে যে ঘাট বা হাট ১০ লাখে ইজারা নেয়া হয়, তারপর সরকারি দলের নেতা ও কর্মকর্তাদের ৫০ থেকে ৬০ লাখ ঘুষ দিয়ে একজন ইজারা নেন। তারপর তিনি এক থেকে দেড় কোটিতে সাব-ইজারা দেন। তারপর সাব-ইজারাদারেরা ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে তোলেন। অর্থাৎ জনগণের গেল ৫ থেকে ৬ কোটি, কিন্তু রাষ্ট্র পেল মাত্র ১০ লাখ টাকা।  
 
জমিদারেরা যেমন ব্রিটিশের লাঠিয়াল ছিলেন, এই ইজারাদারেরা ৫৩ বছর ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর লাঠিয়াল। তাই কেউ হাট-ঘাটের ইজারা তুলে দেয়ার পক্ষে কথা বলবেন না। 


২.
রাষ্ট্রের সেবা ও জবাবদিহি জনমানুষের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য স্বশাসিত এবং সচ্ছল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন জরুরি। স্থানীয় সরকারই হবে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের মূল ধারক ও বাহক। এ লক্ষ্যে সাংবিধানিক বণ্টন চুক্তির মাধ্যমে, রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ, জেলা সরকারের আয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। জেলা সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কেন্দ্রের কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে জেলার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবেন। 

প্রাথমিকভাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে জেলা ক্যাডার নিয়োগ দিয়ে জেলাগুলোর নিজস্ব প্রশাসন তৈরি করতে হবে। সাংবিধানিকভাবে জেলা সরকার, উপজেলা সরকার ও ইউনিয়ন সরকারের ভেতর কাজের দায়িত্ব এবং বাজেট বণ্টন করে দিতে হবে। পুলিশের সেবাকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে এবং পুলিশ যাতে আর কোনো দিন কেন্দ্রীয় সরকারের দাস হয়ে উঠতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে, পুলিশ প্রশাসনের কেন্দ্রীয় কাঠামো ভেঙে দিয়ে পুলিশকে স্থানীয় সরকারের অধীনস্থ করতে হবে।


৩.
দেশে নাকি মাছ বাড়ছে। তবে জেলের সংখ্যা কমলো কেন? নদীতে মাছ নেই। এদিকে মাছ বাড়ল কেমন করে? খাল-বিল সব ভরাট কিংবা দখল। এই মাছ তাহলে কার? ইলিশ সাগর থেকে আসে, তাকে রক্ষার জন্য পুলিশ ঘোরে। শত নদীর দেশে শত জাতের মাছ কোথায় গেল? নদী কার? জেলেদের, না নেতাদের? চিলমারীর জেলেদের কেন মাছ ধরার জন্য ব্রহ্মপুত্রের উজানে আসাম যেতে হয় জেল খাটার ঝুঁকি নিয়ে?

আগে জমি থেকে আমরা তুলা পেতাম, সুতা পেতাম। এখন সুতা কেনা লাগে। তুঁত বোর্ড রেশম পোকা খোলাবাজারে বিক্রি করে না। তাদের সঙ্গে কৃষক বাঁধা। সুতা না থাকলে কাপড় আসবে কেমন করে? রেশম পোকার চাষই নেই। কৃষক বন্দী থাকলে তাঁতিও বন্দী থাকেন। সেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ৪ নম্বর প্রতিশ্রুতি ছিল: কৃষিতে সমবায় প্রথা প্রবর্তন এবং সরকারি সাহায্যে কুটির শিল্পের উন্নয়ন। তার বাস্তবায়ন কোথায়? 

 
৪.
চরবাসীর জীবন ভাঙা-গড়ার। গত কয় বছরে চরের আবাদও পাল্টে গেছে। চর ছিল গরু-মহিষের অভয়ারণ্য। এমন উদ্ভিদ ছিল, যা একদিকে চরের মাটিকে শক্ত রাখত, আবার জ্বালানির চাহিদাও মেটাত। বালুদস্যুও ছিল না। শিকড় সোজাসুজি মাটির ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীরে যায়, এমন বিন্না ঘাসের বেষ্টনী চরগুলোয় লাগালে প্রাকৃতিকভাবে বিনা খরচে ভাঙন রোধ ও পশু-পাখি-মাছের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠতে পারে। হতে পারে গোখাদ্যের উৎসও। 
  
এছাড়া ২০০ থেকে ৪০০ বর্গফুট সাইজের বস্তা ব্যবহার করেও বড় বড় ভাঙন রোধ করা যায়। বাংলাদেশের বহু জায়গায় এভাবে ভাঙন রোধ করা হয়েছে। কৃষকের জমির প্রতি কারও যেন দরদ নেই। 

প্রভাবশালীরাই ভূমিহীন সেজে চরের খাসজমির দখলদার। আগে এজমালি কাশবন ছিল। যাঁর কিছুই ছিল না, তিনিও দুটি গরু আধি করতেন। এখন গোখাদ্য কিনতে সক্ষম টাকাওলারাই গরু ও মহিষের মালিক। এ কেমন বাংলাদেশ বানালাম! 


৫.
সত্য হলো, নিজ দেশে পরবাসী অন্য জাতিসত্তাগুলো। পাহাড়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের নামে, সমতলে দলিল না থাকার নামে জমি দখল হয়েছে। চিনিকলের নামে জমি নিয়েছে, কিন্তু চিনিকল বন্ধ হলেও জমি ফেরত পায়নি। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে বিএনপির আমলে কয়লাখনির মামলা আর গোবিন্দগঞ্জে আওয়ামী আমলে পুলিশ বাড়িতে আগুনও দেয়, মামলাও দেয়।

মধুপুরে সামাজিক বনায়নের নামে উচ্ছেদ করে। বনে, পাহাড়ে, চা-বাগানে শত বছর বাস করেও তাঁরা উদ্বাস্তু। গত বছর ভূমি মালিকানা না থাকায় চা বাগানের একজন শিক্ষার্থী চাকরি না পাওয়ার ঘটনা আমরা জানি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে নিশ্চয়ই তাঁদেরও হিস্যা আছে।  


.
গণতান্ত্রিক অনেক দেশে নাগরিকের বুনিয়াদি শিক্ষা ও চিকিৎসা ফ্রি। কমিউনিটি হাসপাতালগুলো চিকিৎসার অভাব পূরণ করে ৮০ শতাংশ। এটা তারা করেছে ঐতিহ্যগত চিকিৎসা ও পাশ্চাত্য চিকিৎসার মিশেল ঘটিয়ে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক মানসিকতা আমাদের যা কিছু স্থানীয়, তাকে অবজ্ঞা করতে শিখিয়েছে। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ থেকে মুক্তিযুদ্ধ আমরা করেছি শিক্ষা ও চিকিৎসা ফ্রি করার জন্য। আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে হাসপাতাল ও মেডিকেল স্কুলে পরিণত করতে হবে, যেন গাঁয়ের কৃষকেরা সেখানে চিকিৎসার জ্ঞান অর্জন করতে পারেন।  

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিজয় দিবসের ভাষণে বলেছেন, গত ১৬ বছরে যেভাবে বরাদ্দ বাড়িয়ে লুট করা হয়েছে, তা দিয়ে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে যথাক্রমে দুই গুণ ও তিন গুণ বাজেট বরাদ্দ করা যেত। এগুলো করতে হবে। ১৫টি ক্ষেত্রে কমিশন হয়েছে, অথচ কৃষি ও ভূমি কমিশন হয়নি। 
 
ঢাকা শহরে ছাত্র, নারী ও শ্রমিক সমাবেশগুলোয় ছাত্র উপদেষ্টারা গেছেন। কিন্তু চরে ও চা-বাগানে তারা কি গেছেন? জেলে, কৃষক ও তাঁতিদের সমাবেশগুলোয় গেছেন? তাঁরা কি জানেন, এই গণ-অভ্যুত্থান তাঁদেরও। সাবেক বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান লিখেছিলেন, ‘আমরা কি যাব না তাদের কাছে, যারা শুধু বাংলায় কথা বলে?’ 

উপদেষ্টারা কি যাবেন না জেলে ও কৃষকদের কাছে?


লিখেছেন: নাহিদ হাসান, লেখক ও সংগঠক

আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

টঙ্গীতে পোশাক কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
টঙ্গীতে ঝুটের গুদামে ভয়াবহ আগুন, আধাঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে
ইউনিয়ন ব্যাংকেরও শীর্ষ খেলাপি দেশবন্ধু গ্রুপ
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ৮৯৬তম সভা অনুষ্ঠিত
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী দলের সভা
ঢাকা দুই সিটিতে আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিএনপির ব্যাপক তদবির
পদত্যাগ করলেন আটাবের সবুজ মুন্সী
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১২ বছর , তবু মেলেনি বিচার, নিশ্চিত হয়নি ক্ষতিপূরণ
শিগগিরই ঢাকা শহরে অটোরিকশার ওয়ার্কশপ ও চার্জিং স্টেশন বন্ধে অভিযান: ডিএনসিসি প্রশাসক
মতামত- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝