সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫,
২ আষাঢ় ১৪৩২
ই-পেপার

সোমবার, ১৬ জুন ২০২৫
মতামত
এমন ভয়-শঙ্কাহীন উদ্‌যাপনই তো আমরা চেয়েছি
মারুফ মল্লিক
Publish: Tuesday, 17 December, 2024, 5:58 PM  (ভিজিট : 203)
মহান বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। গতকাল সকালে। ছবি: সংগৃহীত

মহান বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। গতকাল সকালে। ছবি: সংগৃহীত

বিজয় দিবসের ঠিক আগে গত শনিবার রাতে ফোনে ঢাকায় এক গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে আলাপ করছিলাম। বিভিন্ন আলাপের ফাঁকে তিনি বললেন, ঢাকায় বিজয় দিবস উদ্‌যাপন শুরু হয়েছে। তাঁর কথা শুনে প্রশ্ন রেখেছিলাম, একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এবারের বিজয় দিবসকে কীভাবে দেখছেন? 

উত্তরে ওই সাংবাদিক বলেন, দীর্ঘদিন পর মুক্ত পরিবেশে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করছি আমরা। ভয়-শঙ্কাহীন পরিবেশে মুক্তিযুদ্ধের মহান অর্জনকে উদ্‌যাপন করছে দেশের সবাই। এ হিসেবে এবারের বিজয় দিবস ভিন্ন আমেজ নিয়ে এসেছে আমাদের সামনে। বিজয় দিবসের আনন্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেশকে ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত করার আনন্দও। এখন আর আমাদের প্রচণ্ড রকম সতর্ক হয়ে কথা বলতে হয় না। ক্যাফেতে বসে নিচু স্বরে গুজুর-গুজুর, ফিসফাস করারও প্রয়োজন নেই। 

এবারের বিজয় দিবসের মূল বিষয়টাই হচ্ছে এই ভয়মুক্ত পরিবেশ। বিজয় দিবসের আনন্দ সুনির্দিষ্ট কোনো দলের বা রাজনৈতিক বয়ানের নয়। এই আনন্দ সবার। কিন্তু বিগত ১৬ বছরে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধের বিজয়টাকে নিতান্তই আওয়ামী লীগের ও বাঙালির বিজয় বলে একধরনের একচেটিয়া বয়ানের ওপর দাঁড় করানো হয়েছিল। এ সময়ে নানা বিধিনিষেধের মধ্যে বিজয় দিবস উদ্‌যাপন করতে হয়েছে। সারা দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ মোটেও ছিল না।

অথচ আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মূল চেতনাই ছিল একটি উদার ও সহনশীল রাষ্ট্র ও সমাজ গঠন করা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মূল চিন্তাকে ভূলুণ্ঠিত করে দমবন্ধ করা এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছিল, যেখানে রাজনীতির স্বাভাবিক সমালোচনা করারও সুযোগ ছিল না। চরমভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও যাঁরা কথা বলতে চাইতেন, তাঁদের পরিণতি কী হতো, তা তো আমরা জানিই। লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট মোশতাক আহমেদকে তো কারাগারের ভেতরে মেরেই ফেলা হলো।

বিজয় দিবসের ঠিক এক দিন আগেই প্রকাশিত গুম কমিশনের এক প্রতিবেদনে সরকারি বাহিনীর এসব নৃশংসতার বিবরণ উঠে এসেছে। ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জীবন্ত মানুষের ঠোঁট সেলাই করে দেয়া হতো ধরে নিয়ে গিয়ে। হত্যা করে সিমেন্টের বস্তার সঙ্গে বেঁধে নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছে। এমনকি হত্যা করে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হতো। চলন্ত রেলগাড়ি সেই লাশকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতো। কমিশন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন এখনো দেয়নি। তবে আপাতত গা শিউরে ওঠার মতো রোমহর্ষ নির্যাতনের বিবরণ আমরা ওই প্রতিবেদন থেকে জানতে পেরেছি। স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগ নির্যাতন করার দিক থেকে পাকিস্তানিদের চেয়ে কোনো অংশেই পিছিয়ে ছিল না। আওয়ামী লীগ বিরোধী মত দমন করতে পাকিস্তানিদের মতোই নির্মম পথ বেছে নিয়েছিল।
 
দমন-নিপীড়ন করে আওয়ামী লীগ পুরো দেশই নয়, মুক্তিযুদ্ধকেই কুক্ষিগত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের তৈরি করা বয়ানই ছিল শেষ কথা। আওয়ামী লীগই ঠিক করত কে মুক্তিযোদ্ধা, কে স্বাধীনতাবিরোধী। তাদের শাসনামলে তারা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে স্বাধীনতাবিরোধী বানিয়েছে। আর স্বাধীনতাবিরোধীকে বানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। তারা ভিন্নমতের কারণে নিজ দলের মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার এ কে করিমকেও রেহাই দেয়নি। তাঁকে রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী বলে গালমন্দ করা হয়েছিল। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের সনদ বাতিলেরও উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। 

কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের একার নয়। ১৯৭১ সালের গুটিকয় স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া পুরো দেশের মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে। যেখানে কোনো জাতিগত, রাজনৈতিক, ধর্মী ও সংস্কৃতিগত বিভাজন ছিল না। সবাই বাংলাদেশ গঠনের লড়াইয়ে যোগ দিয়েছিল নিজস্ব রাজনৈতিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকে। 

কিন্তু বিগত সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে এককভাবে বাঙালির বিজয় বলে প্রচার করে সবার অর্জনকে কুক্ষিগত করা হয়েছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই বাঙালির অবদান ও অংশগ্রহণ বেশি ছিল। কিন্তু এর পাশাপাশি অন্যান্য জাতিসত্তা ও ভাষাভাষীরও অংশগ্রহণ ছিল। তাদেরও আমাদের মুক্তির সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। সম্মিলিত লড়াইয়ের অর্জনকে কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের বিজয় বলে চালিয়ে যায় না আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রাধান্য দেয়ার সুযোগ নেই।

একাত্তরের বিজয় সম্মিলিতভাবে সব জাতি ও গোষ্ঠীর আত্মত্যাগের ফসল। তাই এটা শুধু বাঙালির বিজয় নয়; এ বিজয় বাংলাদেশের সবার। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত প্রতিটি জাতি, গোষ্ঠী ও ধর্মের। একেবারে ক্ষুদ্র যে জাতিগোষ্ঠী, তাদের জনসংখ্যা যদি একজনও হয়, তাদেরও এই সাফল্য ও বিজয়ের অংশীদার করতে হবে।

এবারের বিজয় দিবস আওয়ামী লীগের ও বাঙালির একাধিপত্য থেকে মুক্ত। ৫ আগস্টের বিজয় একাত্তরের বিজয়কে মুক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের ৫ আগস্টের অর্জনকে অনুধাবন করতে হবে। ’৭১ ও ’২৪-এর আলোকে বাংলাদেশকে সবার রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে। বাংলাদেশ কোনো একক জাতি বা ধর্মের দেশ নয়।
 
বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে হবে। এটা করার জন্য সর্বাগ্রে ১৯৭১ সালের বিজয়কে বাঙালির বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করার ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। কাজটা আমাদের, মানে বাঙালি জাতিকেই করতে হবে। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। বিজয়ের অর্জনে সবার অংশীদারত্বকে স্বীকার করে নেয়ার মতো উদার হতে হবে। 

আমাদের যেকোনো জাতি বা গোষ্ঠীর একাধিপত্য বাতিল করতে হবে। ৫ আগস্ট হচ্ছে একাত্তরের চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিনির্মাণের নতুন দিশা। ১৯৭১ সালের অর্জন সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। স্বাধীনতার পর আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যে ত্রুটি বা ভুল ছিল, তা শুধরে সবার জন্য বাংলাদেশ গঠন করতে হবে। এ জন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। জাতিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হবে।

এই প্রক্রিয়ায় আমাদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকবে, আদর্শগত নৈকট্য থাকবে না। ভাষা ও সংস্কৃতি এক হবে না। ধর্মীয় বিশ্বাসও বিভিন্নজনের বিভিন্ন রকম হবে। কিন্তু সবার আগে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে পরিহার করে নতুন দিনের রাজনীতি শুরু করতে হবে। রাজনৈতিক, জাতিগত, ধর্মীয় ব্যবধানকে তুচ্ছ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে ৫ আগস্টের অর্জনের আলোকে দেশকে বিবেচনা করতে হবে। আমাদের মূলমন্ত্র হবে সবার আগে বাংলাদেশ। 


লেখক: ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ভারতে ১৫০ পর্যটক নিয়ে ভেঙে পড়ল সেতু, স্রোতে ভেসে গেছেন অনেকে
ডেঙ্গুতে একদিনে আরও ১ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ২৪৯
ইসরাইলি আগ্রাসন প্রতিরোধে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান
কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যায় ও দক্ষিণখানের কাওলায় রাজউকের মোবাইল কোর্ট
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন: ইশরাক
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

আগতাড়াইল মানব কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উপহার সামগ্রী বিতরণ
ঢাকা উত্তরের কৃষকদল নেতা রাফেলসহ কয়েকজনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ
‘আমার বুড়ো বাপকেও তুই ছাড়িসনি’ বলে আওয়ামী লীগ নেতাকে গণধোলাই
ডিএনসিসির উত্তরায় দিয়াবাড়ি কোরবানির পশুর হাটের বর্জ্য এখনো পড়ে রয়েছে
বিমান বিধ্বস্তে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেন এক যুবক
মতামত- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik$gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝