শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫,
৫ মাঘ ১৪৩১
ই-পেপার

শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
মতামত
আগেই ভালো ছিলাম!
হাসান মামুন
Publish: Saturday, 14 December, 2024, 8:30 PM  (ভিজিট : 66)

প্যাকেটজাত সয়াবিন তেল মিলছিলো না তখন। এ ভোজ্যতেল কেন সরবরাহ করা হচ্ছিল না, সে বিষয়ে জল্পনাও চলছিল। বাজারে একটু-আধটু যা পাওয়া যাচ্ছিল, তার দামও নেয়া হচ্ছিল বেশি। তখন পরিচিত এক মুদি দোকানে দাঁড়িয়ে একজন বয়স্ক ক্রেতা বলছিলেন, ‘হাসিনা তো আরও কম দামে তেল খাওয়াইছিল!’ সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ছিলেন সম্ভবত। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘যাও, হাসিনারে ফেরত নিয়া আসো!’

ওই ক্রেতাকে বলে লাভ নেই– সরকার তো কাউকে খাওয়ায় না। পণ্য আর সেবার দাম নির্ধারণও করে দেয় না সরকার। এটা প্রধানত চাহিদা ও সরবরাহের ঘাত-প্রতিঘাতে স্থির হয়। সরকার বা তার ‘রেগুলেটরি অথরিটি’ কিছু ভূমিকা রাখে অবশ্য। ওইটুকুই! কিছু জরুরি পণ্যের ব্যবসা অবশ্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান করে একচেটিয়াভাবে। যেমন জ্বালানি তেল। সরকার চাইলে কর-শুল্ক আর দুর্নীতি কমিয়ে এর দাম কমাতে পারে। ভর্তুকি দিয়েও কম দামে জোগাতে পারে। এটা করলে তার সুপ্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে। গ্যাস-বিদ্যুতের দামও সরকার স্থির করে থাকে। এর দাম কম রাখতে পারলেও মিলবে সুফল। তখন কম দামে সয়াবিন তেল পাওয়াও অত কঠিন হবে না।

দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এভাবে চিন্তা করবে না- এটাও স্বাভাবিক। তারা সরল তুলনাই করবে দুই সরকারের। দুটির চরিত্র অভিন্ন কিনা- সেটাও হয়তো চিন্তা করে দেখবে না। এমনকি তারা স্মরণ করবে ইতোপূর্বে মাসতিনেকের জন্য ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর অভিজ্ঞতা। ইউনূস সরকার যে সাড়ে ১৫ বছরের স্বেচ্ছাচারী শাসনের অবসান ঘটানো নজিরবিহীন গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে এসেছে, সেটাও হয়তো বিচার করে দেখবে না। এ সরকার যে অনেকটা মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর সরকারের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটা সাধারণের পক্ষে বুঝে ওঠা কঠিন। তাদের প্রত্যাশা বরং আকাশসমান। হাসিনা সরকারবিরোধী আন্দোলন চলাকালে কেউ বলেননি, তিন-চার মাসেই পণ্যবাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসে যাবে। মানুষ বরং নিজে নিজেই তৈরি করেছে বিরাট প্রত্যাশা। এটাকে ‘যৌক্তিক’ বলা যায় না।

এমন প্রত্যাশা অবশ্য যৌক্তিক যে, পরিস্থিতির অবনতি অন্তত ঘটবে না এবং ক্রমে উন্নতি হবে। এটা ন্যূনতম প্রত্যাশা যে, নতুন সরকারটি যোগ্যতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। আর সেটা হবে দৃশ্যমান। কথা হলো, ইউনূস সরকার কি পণ্যবাজার শান্ত করে আনায় যথেষ্ট উদ্যোগী? হালে কিছু উদ্যোগ-আয়োজন দেখা গেলেও শুরু থেকেই সেটা কি পরিলক্ষিত? বাণিজ্য উপদেষ্টা নিয়োগ দিতে এত বিলম্ব হলো কেন? আর তাঁকে কেন একজন ব্যবসায়ীই হতে হলো? হাসিনা সরকার আমলে একজন ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী অবশেষে সংসদে দাঁড়িয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন- সেটা কি এত দ্রুত ভুলে গেছে সবাই? বাজার থেকে প্যাকেটজাত সয়াবিন তেল ক’দিন গায়েব থাকার পর বাণিজ্য উপদেষ্টাকে এর দাম আরও বাড়াতে হলো; সেটা কিন্তু খেয়াল করল সবাই। এতে কোনো ‘কিন্তু’ না থাকলেও লোকে বলবে– সবকিছু তো আগের মতোই! পরিবর্তন তাহলে কোথায়?

দেশের সবাই পরিবর্তন চেয়েছিল, তা অবশ্য নয়। সব কিছুর পর হাসিনা সরকারকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইত তাঁর কট্টর সমর্থকরা। আর নিম সমর্থকরা চাইতো, শাসন পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে তিনিই থাকুন ক্ষমতায়। এর পেছনে ছিল তাদের সুগভীর শঙ্কা। তারা এখন ইউনূস সরকারের ব্যর্থতাগুলো ধরে ধরে বলছে- ‘আগেই ভালো ছিলাম।’

কাঁচামরিচের দাম মাঝে লাফ দিয়ে বেড়েছিল। তারপর একযোগে বাড়ে সবজির দাম। প্রায় একই সময়ে লাফিয়ে বাড়ে ডিমের দাম। এমন পরিস্থিতি হাসিনা সরকারের আমলেও হয়নি, তা নয়। সে আমলে টানা দু’বছর উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধকল সইতে হয় মানুষকে। তা সত্ত্বেও হাসিনা সমর্থকরা বলতে লাগল- ‘আগেই ভালো ছিলাম।’ এদের মধ্যে আগে তারাই কেবল ভালো ছিল, যারা উপার্জন করতে পারছিল দু’হাতে। হাসিনা সমর্থক সবার তো অর্থবিত্ত নেই; ছিলও না। তখনকার মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতেও খারাপ ছিল তারা।

রাতারাতি কোনো পরিস্থিতিরই উন্নতি হয় না। ‘বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন’-এর বেলায় পুরোনো বিধি-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পরিস্থিতির অবনতিও ঘটে। তাতে পরিবর্তন সমর্থনকারী জনগোষ্ঠীকেও হয়ে পড়তে হয় হতাশ। এদের একাংশকেও তখন বলতে দেখা যায়- ‘কী লাভ হলো এত কিছু করে!’
 
বেশি আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটলেই পরিস্থিতি বেশি ইতিবাচক হয়ে উঠবে- এমনটাও সরল প্রত্যাশা বৈ-কি। মাথায় রাখা ভালো, রক্তক্ষয়ী পরিবর্তনের পর দেশে দেশে নৈরাজ্যই বেশি বেড়েছে। বেড়েছে পরিবর্তন-প্রত্যাশীদের মধ্যে সংঘাত। কারণ বিভিন্ন পক্ষ পরিবর্তনকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করেছে; একে নিয়ে যেতে চেয়েছে পছন্দের গন্তব্যে। এ অবস্থায় ভালো হয় দ্রুত গণতান্ত্রিক উত্তরণের দিকে যেতে পারলে। অন্যথায় মূলত ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতায় বাড়তে পারে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা। দীর্ঘদিন ধরে চলতে পারে পরাজিত পক্ষের ওপর প্রতিশোধের পালা ও তার প্রত্যাঘাত। ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর কমবেশি এমন পরিস্থিতিই কি বিরাজ করছে না? এ অবস্থায় ‘সরল প্রত্যাশা’ পূরণের সুযোগও কম উপস্থিত। 

সরকার পতনের সঙ্গে এখানে পুলিশ বাহিনীও গিয়েছিল লাপাত্তা হয়ে। সরকারপ্রধানের সঙ্গে স্থানীয় বিদ্যালয় আর মসজিদ কমিটির সভাপতিও ‘দেশ ত্যাগ’ করেন। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর টানা তিন দিন ছিল না কোনো ধরনের সরকার। এমন অবস্থায় দৃশ্যত অপরিকল্পিতভাবে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদে যারা দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাদের সাহসের বরং তারিফ করতে হয়। তবে পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী কাজ করতে অসমর্থ হলে তাদের উচিত নিজে থেকে সরে যাওয়া। এ অবস্থায় নতুন উপদেষ্টা যুক্ত হলেও পুরোনো কেউ সরে যাননি দেখে অনেকে কিন্তু হতাশ। অর্থ উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন, তারা ‘দায়িত্ব’ নিয়েছেন; ‘ক্ষমতা’ নয়। এসব বলে তারা কি রাজনৈতিক দায়িত্ব এড়াতে পারবেন? যেসব সংস্কারের দায় তাদের ওপর বর্তেছে, সেগুলো তো চারিত্রিকভাবে শতভাগ রাজনৈতিক। সামনে যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে, সেটাও সুগভীর রাজনৈতিক তাৎপর্যবাহী। অর্থনীতির যে ব্যবস্থাপনা তাদের রেখে যেতে হবে, তাতেও থাকতে হবে ‘নতুন বন্দোবস্ত’। গোষ্ঠীতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও ‘চোরতন্ত্র’ থেকে জাতিকে মুক্ত করার পথ দেখাতে হবে তাদের। তাতে অন্তত রাখতে হবে প্রথম পদচ্ছাপ।

এমন দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়ে অন্তর্বর্তীকালে দেশ পরিচালনা করতে না পারলে অস্থিরতাই দেখতে হবে মানুষকে। সেটা বেশি দেখা যাবে পণ্যবাজারে, এমনকি সাধারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। চার মাস পরেও জনপ্রশাসনকে বাগে এনে এটিকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে জুড়তে পারেনি সরকার। এমন নজিরবিহীন পরিবর্তনের পর শৃঙ্খলা আসবে কীভাবে? প্রধান রপ্তানি খাতে থেমে থেমে এখনও চলছে অরাজকতা। এটা ঘিরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সড়ক-মহাসড়ক। দীর্ঘ যানজটে আটকে সাধারণ মানুষ তখন বলছে, ‘আগেই ভালো ছিলাম।’ কথাটি আরও বেশি করে উঠবে, যদি চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে যাত্রার সঙ্গে প্রতিদিনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ কিংবা দুর্বল থেকে যায় সরকার। খুব খারাপ হবে, যদি পরিবর্তনের পক্ষের সিংহভাগ মানুষও আস্থা হারিয়ে ফেলে সরকারের ওপর। এ সুযোগে পরিবর্তনের বিরোধী শক্তিগুলো জেগে উঠে যদি দেশকে নিয়ে যেতে চায় বিপথে!


লেখক- হাসান মামুন, সাংবাদিক, কলামিস্ট
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

দুদকের মামলায় বিএফআইইউয়ের সেই মাসুদ বিশ্বাস গ্রেফতার
এনসিটিবি’র সামনে সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০০ জনের নামে মামলা
ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেন যারা
বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক চায় ভারত: জয়সওয়াল
বাংলাদেশে নিপীড়ন বন্ধে প্রয়োজন স্থায়ী সংস্কার: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পথে
ফরিদপুরে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা গন সংযোগে ব্যস্ত
দক্ষতা ও নিষ্টার পুরস্কার, দুদকের মহাপরিচালক-পরিচালক পদে পদোন্নতি
চায়না পোশাকে সয়লাব দেশ
রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে: সালাউদ্দিন
মতামত- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : [email protected]
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝