সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫,
১৫ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার

সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫
মতামত
প্রলম্বিত ডেঙ্গু পরিস্থিতি : কারণ ও প্রতিকার
অধ্যাপক ড. মো: শামীম হোসেন নোমান
Publish: Thursday, 28 November, 2024, 7:01 PM  (ভিজিট : 223)

ডেঙ্গু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরবোভাইরাল রোগ। বাংলাদেশের প্রচলিত মশাগুলোর মধ্যে ৯৮ ভাগ মশাই হল Culex প্রজাতির যা ডেঙ্গুর বাহক নয়। বাকি ২ ভাগের মধ্যে একটা অংশ এডিস যা ডেঙ্গুর বাহক হিসাবে পরিচিত। এই ভাইরাসবাহী Ades aegypti  নামক মশার কামড়ে মূলত ডেঙ্গু জ্বর হয়ে থাকে। এই মশা সাধারণত ভোরবেলা ও সন্ধার পূর্বে কামড়ায়। 

ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশা কোনো ব্যক্তিকে কামড়ালে সেই ব্যক্তি চার থেকে ছয় দিনের (৩-১৩ ক্ষেত্রে) মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়। এবার এই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। তাই ডেঙ্গু জ্বর একাধিকবারও হতে পারে। তবে যারা আগেও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে রোগটি হলে সেটি মারাত্মক হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত তীব্র জ্বর (১০৫ ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়) ও সেই সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। শরীরে বিশেষ করে হাড়, কোমর, পিঠসহ অস্থিসন্ধি ও মাংসপেশিতে তীব্র ব্যথা হয়। এ ছাড়া মাথাব্যথা ও চোখের পেছনে ব্যথা হয়। অনেক সময় ব্যথা এত তীব্র হয় যে মনে হয় হাঁড় ভেঙে যাচ্ছে। তাই এই জ্বরের আরেক নাম ‘ব্রেক বোন ফিভার’। জ্বর হওয়ার চার বা পাঁচদিনের সময় সারা শরীরজুড়ে লালচে দানা দেখা যায়। যাকে বলা হয় স্কিন র‌্যাশ, অনেকটা অ্যালার্জি বা ঘামাচির মতো। এর সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হতে পারে। রোগী অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করে এবং রুচি কমে যায়। 

বর্ষার সময় সাধারণত এ রোগের প্রকোপ বাড়ে, নভেম্বরে সাধারণত এডিস মশাবাহিত এ রোগের প্রকোপ কমে আসে। কিন্তু এবারের চিত্রটা অনেকটাই ভিন্ন। এ বছর নভেম্বরেও ডেঙ্গু মৌসুম চলতে দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুর লক্ষণে পরিবর্তন হয়েছে ফলে ডেঙ্গু সনাক্তকরনে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। জ্বরের তাপমাত্রা খুব বাড়ছে না, শরীরের ব্যথাও তেমন হচ্ছে না। সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা, বমি হওয়া বা পাতলা পায়খানা দেখা দেয়া রোগীর শরীরে ডেঙ্গু সনাক্ত হচ্ছে, অথচ এক দুইদিন পর শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটছে। রোগীর পাল্স পাওয়া যায় না, ব্লাড প্রেসার কমে যায়, প্রস্রাব হয় না, কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। এমনকি রোগী অজ্ঞানও হয়ে যাচ্ছে! এ ব্যতিক্রম শঙ্কিত করছে জনস্বাস্থ্যবিদদের।

এ বছরের ডেঙ্গু অধিক শক্তিশালী। চিকিৎসকদের মতে, এ ডেঙ্গুতে তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, গায়ে র‌্যাশ ও বমির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন ডেঙ্গু হলে সামান্য জ্বরেই হার্ট, কিডনি ও বেইন আক্রান্ত হচ্ছে। সাথে রোগী দ্রুত শকে যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়েছে। বর্তমান বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকেই ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে আছেন। এবার গ্রামের চেয়ে শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। আগে আমরা জানতাম এডিস মশা শুধুমাত্র পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানিতে হয়, এখন দেখা যাচ্ছে নোংরা এমনকি নোনা পানিতেও মশা ডিম পাড়তে পারে। ধারনা করা হতো, এডিস মশা শুধু দিনে কামড়ায়।

 তাই রোগীদের বলা হতো দিনের বেলা মশারি টানিয়ে ঘুমাতে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এ মশা দিনে-রাতে দুই সময়েই কামড়াচ্ছে। আগে সাধারণত বর্ষার বা বৃষ্টিপাতের সঙ্গে ডেঙ্গুর সম্পর্ক থাকতো। এখন দেখা যাচ্ছে সারাবছরই ডেঙ্গু হতে পারে। যেমন এবছর জানুয়ারি থেকে সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি শীতকালেও এর প্রভাব দেখা গেছে। যদিও বৃষ্টিপাতের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। তবে কোথাও জমা পানি থাকলেই কিন্তু এ মশা ডিম পাড়ে। এইসব কারণেই বলা যায় যে, ডেঙ্গুও যেমন নিজের লক্ষণ বদলাচ্ছে, এডিস  মশাও তেমনি বদলাচ্ছে নিজের চরিত্র। 

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, প্রতি ১০০ জন ডেঙ্গু রোগীর মধ্যে ২০ জনের শরীরে ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা যায় এবং এদের মধ্যে ৪-৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তবে এবছর মৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জনে ৫০ জন যা বিগত যেকোন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, যদিও মৃত্যুহার আরও বেশি, কারন সব হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীর তথ্য নেয়া হয়না। যে কারো শরীরে অস্বাভাবিক কোন উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে তার একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো উচিত। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মশার প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি এমনভাবে নিতে হবে যেন আমাদের আশপাশ পরিচ্ছন্ন থাকে।

মশা নির্মূলে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ে, সামাজিক পর্যায়ে সরকারী কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধি, ডাক্তার, এনজিও কর্মী সচেতন নাগরিক সবাইকে নিয়ে ক্রাস এ্যাকশন বাস্তবায়ন করতে হবে। বাসাবাড়ীর আশেপাশে কিভাবে পরিস্কার রাখতে হবে সেই সম্পর্কে নাগরিকদের ট্রেইনিং প্রদান করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রনে মশা নিধনে আমাদের আগ্রহ বেশি, কিন্তু মশার আবাসস্থল ধ্বংস ব্যতীত ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কমানো অসম্ভব। এডিস দমনে যে কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে, সেগুলো রেজিস্টেন্ট হয়ে যেতে পারে, যে ডোজে কীটনাশক প্রয়োগ হওয়ার কথা সেই সঠিক ডোজে কীটনাশক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তা যাছাই করে নতুন ডোজ ক্যালিব্রেশন করা জরুরি। এ পরিস্থিতিতে আমাদের বায়ো কন্ট্রোলের দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।

আমাদের দেশের মানুষ ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন হলেও সক্রিয় নয়। বর্তমান পরিস্থতিকে জরুরি অবস্থার মত ঘোষনা করে ডেঙ্গু মোকাবেলাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রনের মত পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনায় তরুণ সমাজ ও ছাত্র-যুবকদের কাজে লাগাতে হবে। ডেঙ্গু নিধনে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মনিটরিং ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে এবং সচেতন করতে হবে। সর্বপরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে ডেঙ্গু নিধন ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন নিয়ে এসে বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনা চালু করে সমন্বিত টিম গঠণ করতে হবে। সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ ধরণের প্রচেষ্টা অত্যন্ত কঠিন ও দু:সাধ্য।

লেখক: অধ্যাপক, কীটতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর-১৭০৬, ইমেইল:: shamim.ent@bsmrau.edu.bd.

আ. দৈ. /কাশেম 
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

টঙ্গীতে পোশাক কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
টঙ্গীতে ঝুটের গুদামে ভয়াবহ আগুন, আধাঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে
ইউনিয়ন ব্যাংকেরও শীর্ষ খেলাপি দেশবন্ধু গ্রুপ
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ৮৯৬তম সভা অনুষ্ঠিত
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী দলের সভা
ঢাকা দুই সিটিতে আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিএনপির ব্যাপক তদবির
পদত্যাগ করলেন আটাবের সবুজ মুন্সী
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১২ বছর , তবু মেলেনি বিচার, নিশ্চিত হয়নি ক্ষতিপূরণ
শিগগিরই ঢাকা শহরে অটোরিকশার ওয়ার্কশপ ও চার্জিং স্টেশন বন্ধে অভিযান: ডিএনসিসি প্রশাসক
মতামত- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝