রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫,
১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার

রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
মতামত
ভূমি কর
সিম গেল তো জমিও গেল!
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী
Publish: Sunday, 20 October, 2024, 1:36 PM  (ভিজিট : 191)
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী । ছবি: সংগৃহীত

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী । ছবি: সংগৃহীত

যমের সান্নিধ্য জীবনসায়াহ্নে একবারই মোকাবিলা করতে হলেও জমির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি। মানুষ ‘ভূমিষ্ঠ’ হয়; মৃত্যুর পরও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ভূগর্ভেই থিতু হয়। আর গোটা জীবৎকাল তো জমির ওপরেই সব কিছু। সব মানুষেরই আকাঙ্ক্ষা- নিজের জমি থাকুক; সেই জমির মালিকানা ঠিক থাকুক। আধুনিক যুগে নানাবিধ সম্পদ হওয়ার পরও মানুষের মৌল ধারণা- জমিই সম্পদ। হানাহানি-মারামারির সিংহভাগই ঘটে থাকে জমির দখলদারিত্ব নিয়ে। এই দখলদারিত্ব প্রমাণের বড় দলিল খাজনা পরিশোধ। অনাদিকাল থেকে মানুষ জমির দখলদারিত্ব রাখতে কর দিয়ে আসছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সূর্যাস্ত আইন বানিয়ে হুকুম দিয়েছিল চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে খাজনা পরিশোধ না করলে জমিদারিই বাতিল। শুধু সময়মতো খাজনা না দেওয়ার অপরাধে তখন অনেকে জমিদারি হারিয়েছিলেন। এক পর্যায়ে জমিদারি ব্যবস্থাই উচ্ছেদ হলো। কৃষক নিজে হলো জমির মালিক। কৃষকের সঙ্গে সম্পর্ক হলো রাষ্ট্রের। এখন রাষ্ট্রকে সরাসরি খাজনা দেয় কৃষক। সূর্যাস্ত আইনের বিপরীতে ১২ বছরের খাজনা একবারে দিলেও রাষ্ট্র বেজার হয় না। 

১৯৭২ সালে ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ হয়ে গেল। কৃষক খুশি খাজনা দিতে হবে না বলে; আবার ভয়- জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে না তো! রাষ্ট্র কৃষকের ভয় বোঝে। ভয়ের কারণ বোঝে। সহজ সমাধান বেরোল- প্রতি খতিয়ানে ২ টাকা ভূমি রাজস্ব দিয়ে পাওয়া যাবে দাখিলা; প্রমাণ থাকবে জমির ওপর কৃষকের মালিকানার। বেশি জমির মালিক, শহর এলাকার জমির মালিক যথারীতি খাজনা, বদলে যাওয়া নাম ভূমি উন্নয়ন কর দিয়ে আসতে থাকেন তহশিল অফিসে। তহশিল অফিসের নাম বদলে হয়ে গেছে ইউনিয়ন ভূমি অফিস। শতাব্দীপ্রাচীন নাম তহশিলদার এখন গালভরা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা। মানুষের জমি-জিরাতের তৃণমূল পর্যায়ের হিসাব রক্ষাকারী।

ডিজিটালের চক্করে বদলে গেল নিয়ম। মোবাইল ফোনে ফোনেই দিয়ে দেয়া যায় ভূমি উন্নয়ন কর। অফিসে গিয়ে অফিসারকে পেলাম কি পেলাম না, সে ভোগান্তি নেই। যদিও কিঞ্চিৎ ভোগান্তি আছে সার্ভারের সংযোগ নিয়ে। তারও সহজ সমাধান রাতের গভীরে; যখন কেউ সাধারণত সার্ভারে ঢোকে না, তখন ঢুকে পড়তে পারলে কর পরিশোধ হয়ে যাবে নিমেষে। সার্ভার তো চা-নাশতা খায় না, তাই সে খরচের আব্দারও নেই। ভূমি অফিসে যাতায়াতের যে রাহা খরচ তাও বেঁচে গেল। খুশিতে বাগবাকুম হওয়ার কথাই। কিন্তু সবাই কি খুশি হতে পারে?

এক ভদ্রমহিলা নামজাদা মরমি কবি ও ভূস্বামীর বংশধর। উত্তরাধিকারসূত্রে এক খণ্ড জমি পেয়েছেন সাভারে। কয়েক বছর আগে জমির নাম খারিজ হয়েছে তাঁর নামে। ভূমি উন্নয়ন কর দিয়েছেন সনাতনী পদ্ধতিতে; ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে নগদ টাকা জমা দিয়ে আসছেন। সর্বশেষবার ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা জেনে নিয়েছিলেন তাঁর মোবাইল ফোন নম্বর। 

আগের বৈশাখ-চৈত্র মাসের পরিবর্তে এখন কর নেয়া হয় জুলাই-জুন হিসাবে। গত জুলাই মাসের উত্তাল সময়ে ভদ্রমহিলা স্বামীসমেত গেলেন সাভারে খাজনা দিতে। স্বামী একদা জেলা প্রশাসক ছিলেন। কর দিতে গেলে ভূমি অফিস দেখিয়ে দিল কম্পিউটারের দোকান। কারণ সরকারি অফিস নয়, সেবা প্রদানের দায়িত্ব এখন বেসরকারি কম্পিউটার দোকানের। সেখানেই শুরু হলো বিপত্তি। 

কর পরিশোধ করতে হলে ভদ্রমহিলার সেই ফোন নম্বর লাগবে, যে সিমটি নিবন্ধন করা হয়েছে তাঁর ভূমির বিপরীতে। কিন্তু তিনি আগের সিমটি বহুদিন ধরে ব্যবহার করেন না; নম্বরও মনে নেই। কম্পিউটার সেবাদাতা নাচার। তাঁর কিছুই করার নেই। ভদ্রমহিলা আবার হাজির ইউনিয়ন ভূমি অফিসে। স্বামীর পূর্বপদবির সূত্রে ভূমি অফিসের সদাশয় কর্মচারী বের করে দিলেন নিবন্ধিত নম্বরটি; সেটা ব্যবহার করেই কর পরিশোধ করতে হবে।

কাজটি দৃশ্যত সহজ। প্রক্রিয়া শুরুর পর ওই মোবাইল নম্বরে ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) আসবে। ফিরতি বার্তা পেলে সার্ভার নিশ্চিন্ত হবে- সঠিক মালিকই কর দিচ্ছেন। এরপর নির্দিষ্ট মোবাইলটি বা অন্য কোনো মোবাইল থেকে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ভূমি উন্নয়ন করের সমপরিমাণ টাকা পাঠালেই কর পরিশোধ হয়ে যাবে। চাইলে কম্পিউটারের দোকান থেকে কর পরিশোধের প্রমাণও প্রিন্ট করে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু আলোচ্য ভদ্রমহিলার ভোগান্তি তখনও বাকি। আরাধ্য সিমটির বর্তমান ব্যবহারকারী পোলট্রি ব্যবসায়ী। তাঁর সাফ জবাব- ওটিপি জানাতে পারবেন না। কেন জানাবেন? কী নিশ্চয়তা আছে যে, প্রতারকের পাল্লায় পড়ব না! জুলাইয়ের পর অক্টোবর যায় যায়; ভদ্রমহিলার ভূমি কর পরিশোধ হয়নি। সমাধানের কোনো পথ খোলা নেই।

মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে ভূমি কর পরিশোধের পদ্ধতি চালুর আগে কি যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করা হয়েছিল? মানুষের ফোন নম্বর নানা কারণেই বদলে যেতে পারে। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর অনেকেরই দেশে জমি আছে। এই তুঘলকি ব্যবস্থা চালুর আগে আত্মীয়স্বজন ভূমি অফিসে গিয়ে কর পরিশোধ করে এসেছেন। এখন কর দিতে হলে সেই প্রবাসীর ব্যবহৃত ফোনটি দেশে থাকতে হবে। আবার সিমটি এক বছরের বেশি অব্যবহৃত থাকলে নম্বরটি অন্য কারও কাছে বিক্রিও হয়ে যেতে পারে। তখন ভূমি কর দিতে গিয়ে ভোগান্তির শেষ থাকবে না।

আমার পরামর্শ, ভূমি কর পরিশোধের ডিজিটাল পদ্ধতি বহাল থাকলে ফোন নম্বর পরিবর্তনের সুযোগ থাকুক। জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর যেহেতু বদলাচ্ছে না, শুধু ফোন নম্বর পাল্টে গেলে এত হেনস্তার অর্থ কী? রাষ্ট্র কি মানুষের ফোন নম্বর বদলানোর স্বাধীনতাটুকুও হরণের পক্ষে? আর ফোন নম্বর বদলালেই জমি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে হবে কেন? 

ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর দেয়া হয়তো আরামের। তবুও দোহাই লাগে, এত আরাম চাই না। ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে বছর বছর খাজনা দিতে চাই। উঠে যাক ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের তুঘলকি নিয়ম। যদি রাখতেই হয়, এটা নিশ্চিত করা হোক- পূর্ব গ্রাহকের সম্মতি ছাড়া অব্যবহৃত সিম নম্বর ফোন কোম্পানি পুনঃবিক্রয় করতে পারবে না। সেই সঙ্গে নতুন ভূমি আইনে তিন বছর কর না দিলে জমি খাস করে নেওয়ার বিধানটিরও রদ চাই। কর পরিশোধের সময় আগের মতো ১২ বছরে ফিরিয়ে আনা হোক।


লেখক: আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

টঙ্গীতে পোশাক কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
টঙ্গীতে ঝুটের গুদামে ভয়াবহ আগুন, আধাঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে
ইউনিয়ন ব্যাংকেরও শীর্ষ খেলাপি দেশবন্ধু গ্রুপ
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ৮৯৬তম সভা অনুষ্ঠিত
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী দলের সভা
পদত্যাগ করলেন আটাবের সবুজ মুন্সী
ঢাকা দুই সিটিতে আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিএনপির ব্যাপক তদবির
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১২ বছর , তবু মেলেনি বিচার, নিশ্চিত হয়নি ক্ষতিপূরণ
শিগগিরই ঢাকা শহরে অটোরিকশার ওয়ার্কশপ ও চার্জিং স্টেশন বন্ধে অভিযান: ডিএনসিসি প্রশাসক
মতামত- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝