বর্তমান সময়ে বিশ্বের বহু দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও বিচারহীনতা একটি সাধারণ চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতে বারবার একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়—একটি রাষ্ট্রে শান্তি, সুবিচার ও জনগণের প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিতে কোনটি উপযোগী: গণতন্ত্র না খেলাফত? বিষয়টি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং আদর্শিক, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে।
খেলাফতের মূলনীতি ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট :
খেলাফত শব্দের অর্থ হল প্রতিনিধিত্ব—খালিফা মানে প্রতিনিধি। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহর জমিনে মানুষ খলিফা, আর রাষ্ট্রপ্রধান হল আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের প্রতিনিধি। মহানবী (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম পরস্পর পরামর্শক্রমে আবু বকর (রাঃ)-কে খলিফা নিযুক্ত করেন। এরপর চার রাশেদীন খলিফার আমলে ইসলামী খেলাফতের প্রকৃত রূপ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই শাসনব্যবস্থায় ন্যায়বিচার, দয়া, অর্থনৈতিক ভারসাম্য, মানবিক মর্যাদা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরতা এবং সর্বোপরি আল্লাহর বিধানের শাসন ছিল মূল স্তম্ভ। খলিফা ছিলেন শাসক নন, বরং জনগণের আমানতের দায়িত্বশীল।
উদাহরণস্বরূপ, হযরত ওমর (রাঃ)-এর আমলে একজন সাধারণ ইহুদিও মুসলিম সেনাপতির বিরুদ্ধে মামলা করে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। এমন ইনসাফপূর্ণ উদাহরণ ইতিহাসে বিরল।
গণতন্ত্র: আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কিন্তু আদর্শগত সংকটে:
গণতন্ত্রের মূল দর্শন হল “জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের শাসন।” জনগণ নেতৃত্ব বেছে নেয়, নেতৃত্ব জবাবদিহিমূলক হয়, এবং আইন সমভাবে প্রযোজ্য হয়। পশ্চিমা দুনিয়ায় গণতন্ত্র একটি সফল কাঠামো হিসেবে পরিগণিত হলেও বাস্তবে দেখা যায়, গণতন্ত্র অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্বে পরিণত হয়।
দলীয় স্বার্থ, ব্যক্তিগত ক্ষমতালিপ্সা, ভোট কেনাবেচা, মিথ্যা প্রচার এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মতো অনৈতিক কৌশলের মাধ্যমে গণতন্ত্র আজ অনেকক্ষেত্রে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। জনগণের নামে গণতন্ত্র চলে, কিন্তু জনগণের প্রয়োজন পূরণ হয় না।
বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে গণতন্ত্র চর্চা করতে গিয়ে দেখা যায় ধর্মীয় মূল্যবোধ হুমকির মুখে পড়ে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিরোধী তৎপরতা বাড়ে, দুর্নীতি ও দমন-পীড়ন চর্চার মাধ্যমে গণতন্ত্রের আস্থা নষ্ট হয় ইত্যাদি।
আজকের বাস্তবতায় খেলাফতের প্রয়োজনীয়তা:
খেলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলতে অনেকেই ভুলভাবে খিলাফত রাষ্ট্র বা আইএস ধরনের গোষ্ঠীর কথা বোঝে। কিন্তু প্রকৃত খেলাফত হল এমন একটি শাসনব্যবস্থা যা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে পরিচালিত হয় এবং সর্বস্তরে ন্যায় ও জবাবদিহিতার নিশ্চয়তা দেয়।
আজকের বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে নৈতিক অবক্ষয়, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার,সামাজিক বৈষম্য প্রভৃতির বিরুদ্ধে স্থায়ী সমাধান চাইলে কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়, চাই নৈতিক নেতৃত্ব ও আল্লাহভীতির ভিত্তিতে প্রশাসন। সেটিই ইসলামী খেলাফতের মূল শিক্ষা।
সম্ভবত খেলাফত ও গণতন্ত্রের সমন্বয়ই পথ হতে পারে :
বর্তমান বিশ্বে খেলাফতের আদর্শ অনুসরণ করে একটি মূল্যবোধভিত্তিক গণতন্ত্র গঠন সম্ভব। যেখানে নেতৃত্ব হবে আল্লাহভীতিসম্পন্ন, আইন হবে শরীয়াহর পরিপন্থী নয়, মানুষের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে, নারী-পুরুষ সকলের মর্যাদা ও সুরক্ষা নিশ্চিত হবে,ধর্মের স্বাধীনতা থাকবে কিন্তু রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি হবে নৈতিক।
একই সাথে জবাবদিহিতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা থাকবে। একে বলা যায় ইসলামী গণতন্ত্র বা শরীয়াহসম্মত রিপাবলিক।
খেলাফত ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে প্রয়োজন প্রকৃত বুঝ ও বাস্তবতা বিশ্লেষণ। খেলাফতের নাম নিয়ে যারা চরমপন্থা চালায়, তারা ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা লঙ্ঘন করছে। আর যারা গণতন্ত্রের নামে দুর্নীতিকে প্রতিষ্ঠা করে, তারাও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।
খেলাফতের নৈতিকতা, গণতন্ত্রের জবাবদিহিতা, ন্যায়ভিত্তিক প্রশাসন,নেতৃত্বে আল্লাহভীতি ও জনগণের কল্যাণের মনোভাব এই সমন্বয়ই হতে পারে আগামীর সুশাসনের পথ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট ।
আ. দৈ/ কাশেম