ছবিতে- কালো কোট পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল বুলবুল, অপরজন ফারুক
ক্রিকেটে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল এবার বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নতুন সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন। দীর্ঘদিন আইসিসির গেম ডেভেলপমেন্টে কাজ করা আমিনুল এবার হাল ধরেছেন দেশের ক্রিকেটের। অরপদিকে বিসিবি সভাপতির পদ হারিয়েছেন ফারুক আহমেদ। কারণ জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) মনোনয়ন বাতিলের ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিসিবির পরিচালকের পদ হারিয়েছেন তিনি। যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিসিবির সভাপতির আসনটি হারিয়েছে ফারুক আহমেদ। না পালিয়ে লড়াইয়ের চালিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছেন ফারুক আহমেদ।
এদিকে আজ শুক্রবার (৩০ মে) প্রজ্ঞাপন জারি করে আমিনুল ইসলামকে বিসিবির পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। এদিন ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালকদের সভায় পরিচালকদের প্রত্যক্ষ ভোটে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন দেশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। বিসিবির পরিচালকদের অনাস্থার কারণে গত ২৯ মে ফারুক আহমেদের পরিচালক পদ প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। এরপর তিনি বিসিবির সভাপতি হিসেবে থাকার যোগ্যতা হারালেন। তার পরিবর্তে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্টে কোটা সংস্কার নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের তোপের মুখে পড়ে দেশ থেকে পালিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর সরকারের বিভিন্ন মহলে পরিবর্তন ঘটে। তারই ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডেও। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদকে ক্রিকেট বোর্ডের পরিচালক হিসেবে মনোনয়ন দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোটায় বিসিবির পরিচালক হয়ে পরিচালকদের প্রতক্ষ ভোটে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন ফারুক আহমেদ।
আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
বিসিবির নতুন সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা উজ্জ্বল নক্ষত্র, তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আইসিসির মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আজ শুক্রবার তিনি নির্বাচিত হয়েছেন বিসিবির সভাপতি। তিনি একসময় একজন ফুটবলারও ছিলেন। ঘরোয়া ফুটবলের শীর্ষ পর্যায়ে খেলেছেন। পরে পুরো মনযোগ দিয়েছিলেন ক্রিকেটে। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব করেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরিয়ানও তিনি। পুরোদস্তর ক্রিকেটার হওয়ার আগে বুলবুল যে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়েও খেলেছেন তা অনেকের কমবেশি জানা। এই জানা কাহিনীর মধ্যে কিছু অজনা গল্পও আছে ‘ফুটবলার বুলবুলের’। তিনি এতটাই ফুটবল পাগল ছিলেন যে, এইচএসসি পরীক্ষা না দিয়েই স্টেডিয়ামে ছুটে গিয়েছিলেন ফুটবল ম্যাচে। যে কারণে তাকে দ্বিতীয়বার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হয়েছিল।
আমিনুল ইসলাম বুলবুল ফুটবল ও ক্রিকেট খেলেছেন যখন, তখন স্টেডিয়ামের গ্যালারি থাকতো দর্শকে টইটুম্বুর। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে অর্ধ লক্ষাধিক দর্শকের সামনে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলে ক্রীড়াবিদ হয়েছিলেন তিনি। দেশের খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামের সঙ্গে তার প্রাণের সম্পর্ক। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলে (আইসিসি) কর্মরত বুলবুল দুই দিনের জন্য ঢাকায় আসলেও একবার হলেও ঢু-মারেন স্টেডিয়ামে।
বুলবুলের প্রিয় ক্লাব মোহামেডান। ঢাকায় আসার পর মোহামেডানের খেলা থাকলেই ছুটে যান মাঠে। ক্লাবে যান। এই তো এইবার বিসিবি সভাপতি হতে ঢাকায় এসেও সময় বের করে একদিন মোহামেডান ঘুরে এসেছেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের মুক্তিযোদ্ধা ও ইস্টএন্ড ক্লাবের ম্যাচ দেখতে বুলবুল মাঠে গিয়েছিলেন পরীক্ষার হলে না ঢুকে। ওই সময় বুলবুল ফুটবল খেলতেন ইস্টএন্ড ক্লাবে। ওই ম্যাচটি ছিল ইস্টাএন্ড ক্লাবের রেলিগেশন এড়ানোর ম্যাচ।
ওইদিন বুলবুলের এইচএসসির অর্থনীতি পরীক্ষা ছিল। পরীক্ষার হলে ঢুকতে নটরডেম কলেজে গিয়েও ফিরে এসে ঢুকেছিলেন ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে। আলাপচারিতায় বুলবুল বলছিলেন, ‘ওই ম্যাচে আমার ক্লাব ইস্টএন্ড ১-০ গোলে হেরে গিয়েছিল। রেলিগেশন থেকে দলকে বাঁচাতে পারিনি। ম্যাচের পর অনেক কেঁদেছিলাম।’
ফুটবল ম্যাচের জন্য পরীক্ষা দেননি, সেটা বুলবুল পরিবারের কাউকে বলেননি। রেজাল্টের পর পরিবার জেনেছিল বুলবুল ফেল করেছেন। পরেরবার আবার পরীক্ষা দিয়ে এইচএসসি পাস করেন। পরিবারের সবাই রাগ করতেন, কষ্ট পেতেন বলে বুলবুল ওই ঘটনা চেপেই রেখেছিলেন। ফুটবলে স্ট্রাইকার ছিলেন বুলবুল। পাইওনিয়ার লিগে গেন্ডারিয়া ফেমাসের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতাও হয়েছিলেন। ঘরোয়া ফুটবল লিগের সিঁড়ি বেয়ে তখনকার সর্বোচ্চ আসর ঢাকা প্রিমিয়ারেও খেলেছেন।
বুলবুলের ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নটা শেষ হয়ে যায় ১৯৮৭ সালে। ইস্টএন্ড ক্লাব প্রথম বিভাগে নেমে যাওয়ার পরের বছর বুলবুল নাম লিখিয়েছিলেন প্রিমিয়ারের দল ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে। মোহামেডানের বিরুদ্ধে ম্যাচে বড় ধরনের ইনজুরিতে পড়েন বুলবুল। পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গেলে ‘ফুলস্টপ’ পড়ে বুলবুলের ফুটবল ক্যারিয়ারে। ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও আমিনুল ইসলাম বুলবুলের চোখ এখনো বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে।
তিনি কখনোই মনে করেন না যে, বাংলাদেশের ফুটবল শেষ হয়ে গেছে। দেখা হলেই ফুটবল নিয়ে বুলবুলের আলাপ চলে। বলেন, ‘আমাদের ফুটবল এগোয়নি। এক জায়গায় থেমে আছে। বিশ্ব ফুটবল এগিয়ে যাওয়ায় আমাদের এ অবস্থা।’দেশের দুই প্রধান খেলা ফুটবল ও ক্রিকেটের সব খবর রাখেন বুলবুল। বিসিবির সভাপতি হওয়ার পর তিনি এই প্রতিবেদকের সাথে ফুটবল নিয়েও আলোচনা করেন। বুলবুল বলেন, ‘আমাদের ফুটবলের ভালো একটা সময় যাচ্ছে। হামজা চৌধুরী ও শামিত সোমের কারণে ক্রেইজ অনেকে বেড়েছে। ফুটবল এগিয়ে গেলে আমার খুব ভালো লাগে।’
বিসিবি থেকে আউট সভাপতির ফারুক আহমেদ:
বিসিবি সভাপতির পদ হারিয়েই লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাই দিলেন ফারুক আহমেদ। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের (এনএসসি) মনোনয়ন বাতিলের ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিসিবির পরিচালকের পদ হারিয়েছেন তিনি। যার ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই শূন্য হয়েছে সভাপতির আসনও। এর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে, তিনি নাকি দেশ ছেড়েছেন। আজ শুক্রবার (৩০ মে) একটি ভিডিও বার্তায় এই খবরকে ‘পুরোপুরি মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি দেশেই আছি। যারা এতদিন আমাকে নিয়ে নাটক তৈরি করেছে, এটা তাদের নাটকের শেষ দৃশ্য মনে হচ্ছে। গুজবে কান দিবেন না। আমি আগামীকাল (শনিবার) একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করার চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেন, কেউ যেন বিভ্রান্ত না হয় এবং তার বিরুদ্ধে চালানো ‘প্রচারণার’ বিরুদ্ধে লড়াই তিনি চালিয়ে যাবেন।
বিসিবি সভাপতির পদচ্যুতির প্রক্রিয়াকে “জোরপূর্বক ও অন্যায়” দাবি করে ফারুক আহমেদ অভিযোগ জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) কাছেও। তিনি জানান, ‘আমি আইসিসি সভাপতির (জয় শাহ) কাছে বিষয়টি অবহিত করেছি। অন্তত ৫-৭ জন পরিচালকের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। আমি বিশ্বাস করি, আইসিসি খুব শিগগিরই পদক্ষেপ নেবে।’
নিজের পুনর্বহালের আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে শ্রীলঙ্কায় মন্ত্রিসভা পুরো বোর্ড ভেঙে দিয়েছিল। তখন আইসিসি হস্তক্ষেপ করে তাদের ফের বসিয়েছিল। আমার ক্ষেত্রেও আইসিসি তৎপর ভূমিকা নেবে বলে আশা করি।’
বিসিবির ৮ পরিচালক সম্প্রতি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে ফারুক আহমেদের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানান। অভিযোগের তালিকায় ছিল অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার। সেই চিঠির ভিত্তিতেই গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তার মনোনয়ন প্রত্যাহার করে এবং নতুন কাউন্সিলর হিসেবে আমিনুল ইসলাম বুলবুলকে মনোনয়ন দেয়। বিসিবি পরিচালকরাও পরে সেই মনোনয়ন অনুমোদন করেন।
ফারুক আহমেদের ভাষ্য, এই পরিস্থিতির শেষ দেখে নেয়ার পর তিনি থামবেন। তার ভাষায় তিনি লড়াই চালিয়ে যাবেন এবং তার সঙ্গে যে অন্যায় হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরবেন। তার এখনও বিশ্বাস বিষয়টি ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে। আগামীকাল ফারুক আহমেদের প্রতীক্ষিত সংবাদ সম্মেলনেই হয়তো জানা যাবে, তিনি কোন পথে এগোচ্ছেন,আইনি লড়াই, না আন্তর্জাতিক সহায়তার পথ ধরে ফিরে আসার চেষ্টা।
আ. দৈ./ কাশেম