বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদকে কৌশলে বৈধ করার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী ও গণপূর্তের কর্মকর্তাসহ সরকারি ৪ চাকরিজীবীর বন্ধুর স্ত্রীদের নামের কথিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘রেক্টো লিমিটেড’ গঠন করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রথম শ্রেণির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছেন। ব্যবসার ধরণ আমদানি-রপ্তানি ও ফার্মেসির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের কোম্পানির ব্যাংক হিসাব ও কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত হিসেবে সন্দেহজনক লেনদেনের সুনিদিষ্ট অভিযোগ সত্বেও দায়মুক্তি পেয়ে যাচ্ছেন।
২০২১ সালের ১ জুন দুদকের মানি লন্ডারিং অনু বিভাগ থেকে বিএফআইইউর কাছে ব্যাংক হিসাবগুলো ফ্রিজ করার জন্য চিঠিও দেয়া হয়। পরে ‘রেক্টো লিমিটেড’এর ব্যাংক হিসাবের লেনদেন বিশ্লেষণ করে ফার্মেসি ব্যবসা ছাড়া আর কোনো ব্যবসার অস্থিত্ব পায়নি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সরকারি এই দপ্তরের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করে আইনী পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জাননো হয়।
কিন্তু দুদকের মানিলন্ডারিং শাখার দায়িত্ব প্রাপ্ত একাধিক কর্মকর্তা উক্ত অভিযোগটি অনুসন্ধানের নামে কয়েক দফা নাটক সাজিয়েছেন। অবশেষে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় অফিসের এক পরিচালক মানিলন্ডারিং শাখায় চলমান ‘রেক্টো লিমিটেডের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করেন। তিনি গত মার্চ মাসে দুদকের সংশ্লিষ্ট শাখায় অভিযোগটি নথিভুক্ত করা এবং অভিযুক্তদেরকে দায়মুক্তির সুপারিশসহ অভিযোটি নথিভুক্ত করার জন্য প্রতিবেদন দাখিলের খবর পাওয়া গেছে। এই বিষয়টি ঢাকা বিভাগীয় অফিসের সংশ্লিষ্ট পরিচালকসহ দুদকের একাধিক কর্মকর্তারা সাথে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রতিষ্ঠানের মালিকরা হলেন, সুস্মিতা সাহানা জামান একজন স্কুল শিক্ষিকা, তার স্বামী ঢাকা দক্ষিণ সিটির একজন প্রকৌশলী পারভেজ রানা। জিন্নাত রহমান একজন গৃহিণী তার স্বামী রবিউল ইসলাম পুলিশের কর্মকর্তা। নাজিয়া রহমান পেশায় একজন চিকিৎসক, তার স্বামী সোহানুর রহমান গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা।
দুদক সূত্রমতে, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুই প্রকৌশলী, গণপূর্তের একজন কর্মকর্তা এবং পুলিশ প্রশাসনের একজন কর্মকর্তারসহ প্রভাবশালী চার বন্ধুর নড়াইল জেলার বাসিন্দা। তাদের স্ত্রী, পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের নামে অনেকগুলো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ওপেন করে বিপুল পরিমান সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন। ‘রেক্টো লিমিটেড’ ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। তাদের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা অর্থের উৎস নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পর্কিত ৯ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের লেনদেন তাদের পেশা বিবেচনায় অসামঞ্জস্যপূর্ণ। ওই ৯ ব্যক্তির ১৭ ব্যাংকে ৭৭টি হিসাব পাওয়া গেছে। তার মধ্যে দুটি ঋণ হিসাব ও ১১টি ক্রেডিট কার্ড হিসাব।
বিএফআইইউ’র প্রতিবেদনটি অধিকতর তদন্তের জন্য দুদকে মানি লন্ডারিং অনু বিভাগের কাছে ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি এক চিঠিতে বিষয়টি অবহিত করা হয়। এরপর দুদক অনুসন্ধান শুরু করে এবং সংশ্লিষ্টদের তলব করেছে। স্বামীদের অবৈধ টাকা বৈধ করতে স্ত্রীদের দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছে তারা।
সূত্র মতে, প্রথমে অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন,মানিলন্ডারিং শাখার উপ পরিচালক আদিপ বিল্লাহ, তিনি প্রতিবেদন দাখিল না করেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান। এরপর উপ পরিচালক ইকবাল হোসেন অভিযোগটি অনুসন্ধান করেন এবং অভিযুক্তদের পক্ষে নথিভুক্ত (দায়মুক্তি) করার সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই প্রতিবেদন আমলে না নিয়ে পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন এবং সহকারী পরিচালক আবু সাইদকে দায়িত্ব দেন। তিনি দীর্ঘদিন নথি চাপা দিয়ে রাখেন। মানিলন্ডারিং শাখার এই গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগটি এক পর্যায়ে এই শাখার সংশ্লিষ্ট পরিচালককে পাশ কাটিয়ে ঢাকা বিভাগীয় একজন পরিচালক ‘রেক্টো লিমিটেড’ নথিটি নিয়ে অনুসন্ধান করেন এবং নথিভুক্ত করার সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই ঘটনায় দুদকের অভ্যন্তরে এক ধরনের সমালোচনা এবং ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ অভিযুক্তদের প্রথম শ্রেনির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলো ‘লাশ ফার্মায় অর্থ বিনিয়োগ করা। এর বাইরে তেমন কোন ব্যবসার তথ্য পায়নি বিএফআইইউ।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রেক্টো লিমিটেড ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন এবং ১৭ জুলাই ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। এ দুটি লাইসেন্স সংগ্রহের আগেই ১২ জুলাই লাজফার্মা লিমিটেডের সঙ্গে ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্যবসার চুক্তি করে। প্রতিষ্ঠানটির লাজফার্মার সঙ্গে করা এ ব্যবসায়িক চুক্তি অস্বাভাবিক। সিটি ব্যাংকের কাকরাইল ভিআইপি রোড শাখার হিসাবটিতে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত চারটি লেনদেন হয়। কোম্পানির পরিচালকদের হিসাব থেকে ট্রান্সফার/ক্লিয়ারিংয়ে মাধ্যমে ২৫ লাখ টাকা করে এক কোটি টাকা জমা হয়। ২০১৯ সালের ৮ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবটিতে চারটি নগদ লেনদেনের মাধ্যমে মোট ৯৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে সুস্মিতা সাহানা জামান দুইবার এবং রবিউল ইসলাম ও পারভেজ রানা একবার করে টাকা উত্তোলন করেছেন।
বিএফআইইউ বলছে, চার পরিচালক তাদের প্রাথমিক বিনিয়োগ জমা করেছেন। আবার কয়েক মাসের ব্যবধানে জমা অর্থের প্রায় পুরোটাই উত্তোলন করেছেন, যা অস্বাভাবিক। তাদের আয়ের উৎস সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য ও দলিলাদি না থাকায় বিনিয়োগ করা টাকার উৎস নির্ণয় করা যায়নি। আবার পুরোটাই জামা ও উত্তোলন,এমন লেনদেন সন্দেহজনক।
এদিকে লাজ ফার্মা ফ্র্যাঞ্চাইজি নামে দুটি ব্যাংকে দুটি হিসাব পরিচালনার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক কোটি ৭ লাখ ১৫ হাজার ৮৪১ টাকা জমা এবং এক কোটি দুই লাখ ১৫ হাজার ৬৫ টাকা উত্তোলন করা হয়।
সুস্মিতা সাহানা জামানের নামে ৭টি ব্যাংকে ১৪টি হিসাব পরিচালনার হিসাবে ২০১১ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট দুই কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৫০৮ টাকা জমা এবং মোট দুই কোটি ৭০ লাখ ৮৮ হাজার ৪৩৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। ১৪টি হিসাবের মধ্যে সিটি ব্যাংকের কাকরাইল শাখার দুটি হিসাবে একক লেনদেন পর্যালোচনা করে গ্রাহকের পেশার (শিক্ষক) সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে। হিসাবের অর্থের উৎস স্বামীর আয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার স্বামী ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশলী পারভেজ রানা।
পারভেজ রানার নামে ৬ ব্যাংকে মোট ১০টি হিসাববে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত দুই কোটি ৯৭ লাখ ১০ হাজার ৯১ টাকা জমা এবং দুই কোটি ৯৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬৬ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাবগুলোয় নগদে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জমা এবং ১৯ লাখ টাকা পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়। সম্পাদিত লেনদেন তার পেশা ও অর্থের উৎসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
এছাড়া পারভেজ রানার মা সেতারা পারভীনের নামে তিনটি ব্যাংকে পাঁচটি হিসাবে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট দুই কোটি ৬৬ লাখ ৭৬ হাজার ২৮৫ টাকা জমা এবং দুই কোটি ৪৯ লাখ ৯ হাজার ৬০৯ টাকা উত্তোলন করা হয়। হিসাবগুলোয় পারভেজ রানা ও তার স্ত্রীকে নমিনি করা হয়েছে।
পারভেজ রানা, স্ত্রী ও মায়ের ব্যাংক হিসাবগুলোতে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে মোট ৮ কোটি ৬০ লাখ ৩২ হাজার ৮৮৫ টাকা জমা এবং আট কোটি ১৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫১৩ টাকা উত্তোলন করা হয়। পারভেজের স্ত্রী ও মা তাদের হিসাবগুলোয় অর্থের উৎস হিসেবে পারভেজের সরবরাহ করা টাকার কথা বলেছেন। প্রায় সব হিসাবের নমিনিও পারভেজ রানা।
নাজিয়া রহমান পেশায় চিকিৎসক তার তিনটি ব্যাংকে তিনটি হিসাবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ লাখ ১২ হাজার ৩৭৯ টাকা জমা এবং ২৮ লাখ ৮৭ হাজার ১৯৮ টাকা উত্তোলন করা হয়। তার লেনদেন পেশার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তার স্বামী সোহানুর রহমান পিডব্লিউডিতে কর্মরত, তার তিনটি ব্যাংকে আটটি হিসাবে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক কোটি ৯৬ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৪ টাকা জমা এবং মোট এক কোটি ৯০ লাখ ৯৮ হাজার ১৫১ টাকা উত্তোলন করা হয়। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ (সংশোধন) আইন, ২০১৫-এর ২(শ)(১) ধারা অনুযায়ী দুর্নীতি ও ঘুষ সম্পৃক্ত অপরাধ।
আ. দৈ./ একে