ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী সরকারের পতন হয়। গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার আগস্টে দায়িত্ব নেয়ার পর হাতে পেয়েছে ভঙ্গুর অর্থনীতি। ছয় মাসে অর্থখাত পুনরুদ্ধারে নানামুখী পদক্ষেপ নিলেও চক্রের ছোবলের প্রভাব থেকে বের করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজার, পোশাকখাত, বাজারব্যবস্থাসহ অর্থনীতির নানা খাতেই পড়েছে এ থাবা। এসব নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পঞ্চম পর্ব আজ
দেশ স্বাধীনের পর সোনালী আঁশখ্যাত পাট রপ্তানি করে দরিদ্র বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখে। যুগের বিবর্তনে আজ তৈরি পোশাক শিল্প সে স্বপ্নের বাতি হয়ে জ্বলছে। নানা ষড়যন্ত্র, প্রতিযোগিতার বাজার উতরে রপ্তানি খাতের ৮২ শতাংশ উপার্জন করছে। এরপরেই রয়েছে রয়েছে চামড়া, প্লাস্টিক, আইসিটি খাত, কৃষি পণ্য প্রভৃতি। সাদা স্বর্ণখ্যাত চিংড়ি একসময়ে ব্যাপক সাড়া জাগালেও সঠিক তত্বাবধানের অভাবে রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। বিশ্ববাজারের মানদন্ডে উৎপাদন ও বিপনন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় বাংলাদেশ রপ্তানির ক্ষেত্রে কাঙ্খিত লক্ষে পৌঁছাতে পারেনি। কৃষকদের জীবন ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ প্রবাদটির মতোই। এরপরে রয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। বলতে গেলে ব্যবসায়ীদের ব্যক্তি উদ্যোগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে এ খাতটি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আন্তর্জাতিক বাজার জরিপ করে দেশিয় রপ্তানি সামগ্রি আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত করতে পারলেই ঘুরে দাঁড়াবে রপ্তানি খাত। আর সঠিক রপ্তানি নীতিই ফেরাতে পারে অর্থনীতির গতিপথ। তাদের মতে, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, রপ্তানিমুখী শিল্পে দক্ষতানির্ভর উৎপাদনে যাওয়া, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা, নতুন নতুন রপ্তানিমুখী সম্ভাবনামুখী শিল্পখাত চিহ্নিত করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতগুলোকেও রপ্তানিমুখী করে গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয় এখনো নজর দেয়ার বাকি রয়েছে।
শুল্ক, ঋণ, প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, বাজার তদারকিসহ কয়েকটি বিষয় সংস্কারের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা বাংলাদেশের সামনে। উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, চীন, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীন থেকে কোটি কোটি ডলারের যে পণ্য সামগ্রি আমদানি করা হয় এক কৃষি পণ্য রপ্তানির মাধ্যমেই আমাদানি-রপ্তানিতে ভারসাম্য আনা সম্ভব।
বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী গুটি কয়েক মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছিল রপ্তানি খাত। বিশেষ করে পক্ষপাতদুষ্ট ভূ-রাজনীতি এই খাতকে অনেকটাই পেছনে ফেলে দিয়েছে। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে বিনিয়োগসহ পণ্য আমদানিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই সুবাতাসে রপ্তানি খাতকে ঢেলে সাজানোর এখনই সময়। এছাড়া এলডিসি উত্তোরণ পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের যে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে সেদিক লক্ষ রেখে এখনই নীতিগত কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
গত তিন বছরের টানাপোড়েনের অর্থনীতির ড্রাইভিং সিটে বসে আট মাস পূর্ণ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এই আট মাসে অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ কিছুটা বন্ধ হয়েছে, তবে টেকসই কতটা হবে, সেটি অনেকটা অনিশ্চিত-এমন মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, অর্থনীতি তিন বছর ধরে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে ছিল। সার্বিকভাবে সেই অবস্থা এখনো রয়ে গেছে। গত আট মাসে মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কিছু কমার লক্ষণ দেখা গেলেও তা উল্লেখযোগ্য নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতির গতি থামছেই না, যা সাধারণ মানুষকে সবচেয়ে ভোগাচ্ছে। তৈরি পোশাক খাত এখন ঠিক হয়নি। নিরাপত্তার দিক থেকে স্বস্তিতে নেই। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। শিল্প এলাকায় স্বস্তিদায়ক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা ও দেশীয় সংকটের চাপ কাটিয়ে এখনো উঠতে পারেনি অর্থনীতি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রপ্তানি খাতের তথ্য উপাত্ত নিয়ে যে বিভ্রাট সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ইপিবি-কাস্টমসের। বর্তশান অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের ফলে এখন তা মোটামুটি একটা জায়গায় এসেছে। এছাড়া প্রচ্ছন্ন রপ্তানিতে যে দুইবার হিসাব করা হচ্ছিল সেখান থেকেও আমরা বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু তথ্যই রপ্তানি খাতের সব না।
রপ্তানির উৎকর্ষতা, এলডিসির গ্রাজুয়েশন পরবর্তী সময়ে যে বাজারসুবিধা চলে যাবে সেটার প্রেক্ষিতে দক্ষতা বাড়ানো, বাজার সুবিধা নির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থেকে বেরিয়ে এসে দক্ষতা এবং উৎপাদনশীলতা নির্ভর প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় উত্তোরণÑ এসব জায়গাগুলোতে এখনো অনেক কাজ করার বাকি রয়েছে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, এলডিসি গ্রাজুয়েশন হয়ে গেলে আমরা যেসব সহায়তা দিতে পারবো না সেগুলোর প্রতিস্থাপন করে কিভাবে আমরা আমাদের রপ্তানিকারকদের নতুনভাবে সহায়তা দিতে পারি, টেকনলজি ফান্ড, বিভিন্ন রিসার্চিং ডেভেলপমেন্টে সহায়তা দেয়া, স্কিল ডেভেলপমেন্টে সহায়তা দেয়াÑ এসব জায়গাগুলোতে প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন প্রণোদনা কাঠামোকে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। তিনি বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পে ভ্যালু এডিশন যেন আরো বেশি হয়। নতুন করে ট্রাম্পের শুল্কনীতি আরোপের বিষয়টি আরো বেশি জটিলতা সৃষ্টি করেছে। এসব জায়গাগুলোতে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে যেন রপ্তানি খাতের বড় ধরনের সমস্যা না হয়। আমাদের রিজার্ভের একটি বড় অংশ রপ্তানিখাতের উপরে নির্ভর করে। সিপিডির এ গবেষক বলেন, তৈরি পোশাক খাতে ভলিউমের উপরেই বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। আমাদের যে রপ্তানি আয়ের বৃদ্ধি ‘রেদার দ্যান প্রাইস’- এ বিষয়ে আমরা কিভাবে আরো উপরের দিকে যেতে পারিÑ এসব জায়গাগুলোতে কাজ করতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রপ্তানিমুখী শিল্পের সাথে শ্রমিকরাও একটি বড় অংশীজন। সেখানে লেবার রিভর্মস করতে হবে। লেবার কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছেÑ মজুরি কত হবে, কত বছর পর পর মজুরি বাড়াতে হবে, সব দিকেই নজর দিতে হবে। একদিকে রপ্তানিকারকদের সহায়তা অন্যদিকে কিভাবে শ্রমিকদের মানসম্মত শোভন কর্মসংস্থান দেয়া যায় সে বিষয়ে নজর দিতে হবে। রপ্তানির সাথে যুক্ত আরো যেসব প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয় রয়েছে- তাদেরও কাজের মানোন্নয়ণ করতে হবে। আমাদের টিকে থাকতে হলে এগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সরকার কিছু কিছু জায়গায় সংস্কার শুরু করে দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, রপ্তানিমুখী শিল্পে দক্ষতানির্ভর উৎপাদনে যাওয়া, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা, নতুন নতুন রপ্তানিমুখী সম্ভাবনামুখী শিল্পখাত চিহ্নিত করা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতগুলোকেও রপ্তানিমুখী করে গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয় এখনো নজর দেয়ার বাকি রয়েছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে রপ্তানি খাত। আর রপ্তানির সর্বাধিক আয় এবং সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকারী শিল্প খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। বর্তমানে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮২ শতাংশ আসে এ খাত থেকে এবং ৮১ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ হয় টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। এক কথায় বলা যায়Ñ তৈরি পোশাক শিল্প হচ্ছে বর্তমানে সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো; তাই দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও প্রসারে পোশাক খাতের ভূমিকা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ যাত্রা শুরুর পর থেকেই নানা সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে এ খাতকে।
নানা অস্থিরতার মধ্যেও পোশাক খাতে রপ্তানি আয় বাড়ছে। তবে এ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতিতে স্বস্তি আনলেও চাপমুক্ত হতে পারেননি পোশাক মালিকরা। কারণ, গত বছরের তুলনায় এবার রপ্তানি বাড়লেও এ খাতের উদ্যোক্তাদের আয় বাড়েনি; উল্টো খরচ বেড়েছে। সরকার নানামুখী উদ্যোগ নেয়ার পরও বেতনভাতা সংক্রান্ত নানা সমস্যায় কাটছেই না শিল্প খাতের অস্থিরতা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, এর নেপথ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং সদ্য ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধন রয়েছে। এছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ ও কাঁচামাল সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া এবং দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে বিপুলসংখ্যক শিল্প মালিকের ব্যাংক হিসাব জব্দের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে যাওয়াও এ খাতে অস্থিরতা সৃষ্টির বড় কারণ। তৈরি পোশাক কারখানাসহ উৎপাদনমুখী অন্যান্য শিল্পের অস্থিরতা কাটিয়ে দ্রুত স্থিতিশীল পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, হঠাৎ করে একসঙ্গে এতো ব্যয় বাড়লে পোশাক কারখানাগুলোর ওপরে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ ক্রমান্বয়ে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাই বেশি প্রত্যাশা করলে উভয় পক্ষেরই ক্ষতি হবে। তিনি বলেন, এমনিতেই পোশাক খাতে বার বার অস্থিরতার কারণে ক্রয়াদেশ অন্য দেশে চলে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্ববাজারে আমাদের রপ্তানি বেড়েছে, এটা আশার দিক। তবে রপ্তানি বাড়ার এ ধারাবাহিকতা যেন থাকে- সেদিকে নজর রাখতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাগুলো এখনো কাটেনি। আবার বাইরের যেসব দেশে পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে- তার অনেক দেশেই মূল্যস্ফীতির সমস্যা রয়েছে। সবকিছু মিলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল মনে হলেও সেটাকে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করার মতো অবস্থা এখনো তৈরি হয়নি বলে মনে করেন এ গবেষক।