যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ইতিবাচকভাবে বিবেচিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে কূটনৈতিক সূত্র। ওয়াশিংটনে চলমান আলোচনার দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশি কর্মকর্তারা মার্কিন প্রতিনিধিদের কাছে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছেন। যদিও এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি, তবে ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমানোর বিষয়ে স্পষ্ট ‘ইতিবাচক ইঙ্গিত’ মিলেছে বলে জানা গেছে।
আজ বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক আলোচনার দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুই পক্ষের দীর্ঘদিনের মতবিরোধ প্রায় মিটে গেছে এবং একটি কার্যকর ও বাস্তবসম্মত সমঝোতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা প্রবল।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক হার সীমিত রাখতে ১০ থেকে ২০ শতাংশের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই পরিসর নির্ধারণের পেছনে আন্তর্জাতিক উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ভিয়েতনাম ২০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন ১৯ শতাংশ, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৫ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ১০ শতাংশ হারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্যরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা শুল্ক কমানোর বিষয়ে শুধু ইতিবাচক মনোভাবই দেখায়নি, বরং এটি বাস্তবায়িত হলে তা হবে ‘সন্তোষজনক মাত্রায়’। আলোচনায় যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘যেখানে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শেষ হয়েছিল অনিশ্চয়তার মধ্যে, সেখানে চূড়ান্ত ধাপে একটি স্পষ্ট ও ইতিবাচক বার্তা মিলেছে—বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্ব পেয়েছে।’
এর আগে, প্রথম দফার আলোচনায় অংশ নেওয়া বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, মার্কিন পক্ষ থেকে পাল্টা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমানোর বিষয়ে ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের ওপর কম শুল্ক আরোপ করা হবে।
বাংলাদেশ এ আলোচনার আগে ভারসাম্য রক্ষায় নানা উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যে রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার অর্ডার, ৭ লাখ টন গম, এলএনজি, তুলা, ওষুধ, মূলধনী যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক কাঁচামাল এবং কৃষিজ পণ্য আমদানির প্রতিশ্রুতি। গত সোমবার পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল যুক্তরাষ্ট্রে রওনা দেয় এই আলোচনার জন্য।
অন্যদিকে ভারত এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো বাণিজ্য চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি। বরং দেশটির ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। একইসঙ্গে, ভারতের ছয়টি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যেগুলো ইরান থেকে জ্বালানি তেল ও পেট্রোকেমিক্যাল পণ্য কেনায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, আলকেমিক্যাল সলিউশনস প্রাইভেট লিমিটেড, গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যালস লিমিটেড, জুপিটার ডাই কেম প্রাইভেট লিমিটেড, রমনিকলাল এস গোসালিয়া অ্যান্ড কোম্পানি, প্রেসিডেন্ট পেট্রোকেম প্রাইভেট লিমিটেড এবং কাঞ্চন পলিমারস।
এই নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ১ আগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক ও অতিরিক্ত জরিমানা আরোপ করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি এবং ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনার বিষয়টিকে এর পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি না থাকা দেশগুলোর ওপর ব্যাপক নতুন শুল্ক আরোপ করছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন। বাংলাদেশের ওপর ধার্য করার পরিকল্পনা আছে ৩৫ শতাংশ শুল্ক। সেই হুমকির পর দেশের রপ্তানিখাতকে রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে শেষ সময়ের আলোচনায় রয়েছে বাংলাদেশ।
এর আগে গত ২৮ জুলাই ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছিলেন, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে ব্যর্থ হবে, তাদের ওপর ১৫-২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এপ্রিলে আরোপ করা ১০ শতাংশ প্রাথমিক শুল্কের পর ট্রাম্পের এই নতুন ঘোষণা বিশ্বজুড়ে আলোচনার ঝড় তোলে। পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, কানাডাসহ অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য শেষ সময়ের আলোচনায় রয়েছে।
এরই মধ্যে গতকাল বুধবার ট্রাম্প বলে দিয়েছেন, ভারতের ওপর তিনি ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবেন। ওদিকে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে বাংলাদেশের। ১ আগস্টের সময়সীমার আগেই চুক্তি চূড়ান্ত করতে মরিয়া প্রতিনিধি দলটি।
বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিনের নেতৃত্বে ওয়াশিংটন ডিসিতে চূড়ান্ত আলোচনার দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল অংশ নিতে যাচ্ছে। উপদেষ্টার সঙ্গে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত বাণিজ্য সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী। আলোচনায় মার্কিন পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছেন দেশটির সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডান লিঞ্চ। তার সঙ্গে আছেন বাণিজ্য ও শুল্কবিষয়ক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির ওপর, বিশেষ করে তৈরি পোশাক রপ্তানির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ২০২৪ সালে মার্কিন বাজারে রপ্তানিকৃত ৮.২ বিলিয়ন ডলারের অধিকাংশই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।
বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, বর্তমানে যে পরিমাণ শুল্ক রয়েছে, তারচেয়ে সামান্য বেশি শুল্ক ধার্য করা হলেও রপ্তানি প্রতিযোগিতায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে ধস নামবে শ্রমবাজারেও। ওয়াশিংটন থেকে বাণিজ্য সচিব রহমান আশাবাদ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের অবস্থান গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষায় আমরা বড় ধরনের প্রস্তাব দিয়েছি। এখানে আলোচনার পরিবেশ খুবই ইতিবাচক।’ গত কয়েক সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলটি আলোচনাকৌশল নতুন করে সাজিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ছয় বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে নানা প্রস্তাবনা দিয়েছে।
আগামী পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৫ লাখ টন গম আমদানি এবং কয়েক বিলিয়ন ডলার চুক্তির আওতায় ২৫টি বোয়িং উড়োজাহাজ কেনার পরিকল্পনা করেছে সরকার। পাশাপাশি, মার্কিন তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), তুলা, সয়াবিন ও অন্যান্য কৃষিপণ্য আমদানি বাড়ানোরও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।