বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে ফসলি জমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অবৈধভাবে মাটি কাটার ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। অতিরিক্ত মাটি কাটার ফলে অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং বৃষ্টির মৌসুমে ভূমিধসের আশঙ্কা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি (টপসয়েল) কেটে নেওয়ার ফলে ওই জমি পরবর্তীতে আর চাষের উপযোগী থাকে না। ফলে কৃষকরা দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এদিকে ফেনীতে ফসলি জমির মাটি কাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের অভিযান সত্বেও অবৈধভাবে মাটি কাটার প্রভাব বন্ধ হচ্ছে না।
স্থানীয় কৃষক ফখরুল ইসলাম জানান, “আমাদের জমির পাশে রাতের বেলায় মাটি কাটা হয়, সকালে গিয়ে দেখি জমির কিছু অংশ ধসে গেছে। এতে ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।”
সাম্প্রতিক অভিযানের বিবরণ গত কয়েক মাসে ফেনীর বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের অভিযানে বেশ কিছু অবৈধ মাটি কাটার ঘটনা ধরা পড়েছে।
জানুয়ারি ২০২৫: ফেনী সদর উপজেলার পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের কাশিমপুর এলাকায় মদিনা ব্রিকস ও মাথিয়ারা এলাকার সোনালী ব্রিকস ফসলি জমি থেকে মাটি কাটায় প্রতিটি ইটভাটাকে ১ লাখ টাকা করে মোট ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
ডিসেম্বর ২০২৪: ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফসলি জমি থেকে মাটি কাটার বিরুদ্ধে ২৩ দিনের মধ্যে ১৪টি অভিযান পরিচালিত হয়। এতে পাঁচ মামলায় ৫ ব্যক্তিকে মোট ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। জানুয়ারি ২০২৫: ফেনী সদর উপজেলায় অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি কাটার অভিযোগে পৃথক অভিযানে ৩টি ট্রাক জব্দ ও একটি এস্কেভেটর অকেজো করা হয়। জানুয়ারি ২০২৫: ছাগলনাইয়া উপজেলায় ফসলি জমির মাটি কাটায় দুইটি এক্সকাভেটর জব্দ ও ২ লাখ ৩ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
জানুয়ারি ২০২৫: ফেনী সদর উপজেলায় অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি কাটার অভিযোগে পৃথক অভিযানে তিনটি ট্রাক জব্দ ও একটি এস্কেভেটর অকেজো করা হয়। জানুয়ারি ২০২৫: ফেনী সদর উপজেলায় ফসলি জমির মাটি কাটার অপরাধে ক্রেতা-বিক্রেতা ও গাড়ির চালককে আটক করে ফেনী থানায় হস্তান্তর করা হয়।
প্রশাসনের অবস্থান ও চ্যালেঞ্জঃ ফেনী জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন মাটি কাটার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, অভিযান সত্ত্বেও কিছু অসাধু ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মাটি কাটার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
ফেনী জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে স্থানীয় জনগণকে আরও সচেতন হতে হবে এবং তারা যদি আমাদের সহায়তা করে, তাহলে এ সমস্যার সমাধান দ্রুত সম্ভব হবে।”
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতে, শুধু প্রশাসনের অভিযান যথেষ্ট নয়, অবৈধ মাটি কাটার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সমস্যার সমাধানে করণীয় নিয়মিত নজরদারি ও কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। অবৈধ মাটি কাটার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে মাটি কাটার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রশাসনিক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। মাটি কাটার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। মাটি ব্যবসায়ীদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যবস্থা তৈরি করা হলে তারা এই অবৈধ ব্যবসা ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হতে পারেন। প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো দরকার। ড্রোন ক্যামেরা ও স্যাটেলাইট ইমেজিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালিয়ে অবৈধ মাটি কাটার স্থানগুলো চিহ্নিত করা এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
ফসলি জমির মাটি কাটা শুধু কৃষি খাতের জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। অবৈধ মাটি কাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্থানীয়দের সক্রিয় অংশগ্রহণই পারে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে। যদি এখনই যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে খাদ্য উৎপাদন কমে গিয়ে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
তাই প্রশাসন, স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত উদ্যোগই পারে কৃষি জমি ও পরিবেশ রক্ষা করতে।
আ. দৈ. /কাশেম