মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫,
২৮ শ্রাবণ ১৪৩২
ই-পেপার

মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট ২০২৫
মতামত
ছোটবেলার বড়দিন
আহমেদ মুনির
Publish: Friday, 27 December, 2024, 7:02 PM  (ভিজিট : 339)

শৈশবে আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা থাকতাম চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে। রেলওয়ের বাংলো বাড়িটার পাশে একটা ছোট খেলার মাঠ, সেটা পার হলেই হাসপাতাল। বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষেই ছোট ছোট কটেজ। তার একটাতেই থাকতেন নিকোলাস ডিকস্টা।

রেলওয়ের জায়গায় গড়ে ওঠা সেন্ট জেভিয়ার্স নামের যে মিশনারি স্কুলে আমি পড়তাম, সেখানেই নিকোলাস স্যার পড়াতেন। তাঁর মাথায় ছিল কোঁকড়া চুল। কথায় খানিকটা জড়তা থাকলেও ভীষণ উচ্ছল ছিলেন।

স্যারের বাড়িতে যেকোনো উৎসবেই আমাদের আমন্ত্রণ ছিল। না গেলে তিনি নিজেই এসে হাজির হতেন। বড়দিন উপলক্ষে তৈরি কিশমিশ দেয়া কেকের স্বাদ আর ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজানো ডিসকো গান ‘ওয়ান ওয়ে টিকিট’ যেন এখনো জিবে আর কানে লেগে আছে।

আশির দশকের কথা। চট্টগ্রাম তখনো ছাড়া ছাড়া বসতের নিরিবিলি শহর। সন্ধ্যায় প্রায় সব রাস্তায় শেয়াল বের হয়। আর আমি পায়ের ঢিলা মোজা রাবারব্যান্ড দিয়ে টাইট করে স্কুলে যাই। বড়দিন তখনো বড় কোনো ঘোষণা দিয়ে আসত না। উৎসবে বড় একটা জাঁকজমকও ছিল না।

সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলটা ছিল ছোট একটা টিলার ওপর। স্কুলবিল্ডিংয়ের গায়ে লাগানো ছোট গির্জা। এ কারণে আমাদের স্কুলটাকে লোকে গির্জা স্কুলও বলত। গির্জার জানালায় রঙিন কাচের শার্সি লাগানো। বড় দরজাটা কেবল রোববার খোলা হতো।

জানালার ফাঁক দিয়ে কতবার দেখেছি ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে। আমি আর আমার সহপাঠী ম্যানুয়েল গোমেজ লেজার পিরিয়ডে চলে আসতাম গির্জার সামনের চত্বরটায়। কখনো উঠে যেতাম গির্জার পাশেই স্থাপন করা রেলওয়ের বড় পানির রিজার্ভারের ওপর। পাইপ বেয়ে উঠতে হতো বলে সেটা ছিল আমাদের জন্য অনেক দুঃসাহসিক কাজ। ওপরে উঠলে সমুদ্র দেখা যেত। বড় ফিতার মতো একচিলতে সমুদ্র।

আমাদের কাছে ওই ট্যাংকের ছাদটাই তখন পৃথিবীর উঁচুতম স্থান। সেখানে বসে গির্জার তত্ত্বাবধায়কের ছেলে আমার সহপাঠী ম্যানুয়েল বলত যিশুর কথা। যিশু রাগী না ক্ষমাশীল, সে বিষয়ে তার দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে বলতো, নিশ্চয় যিশু ক্ষমাশীল।

পড়ায় ফাঁকি দেয়া, খোঁয়াড়ের ডিম চুরি আর বাবার পকেট থেকে না বলে আট আনা নেয়ার পাপ নিয়ে বিচলিত ম্যানুয়েল জানতে চাইত, তার শাস্তি হবে কি-না। আমি সরাসরি উত্তর দিতাম, ‘দোজখে যাবি।’ সে চিন্তিত হয়ে পড়ত। তারপর বলত, ‘যিশু ক্ষমা করবেন।’

পাহাড়তলীর গির্জা ম্যানুয়েলদের বাড়ি, তার পাশে মাস্টারপাড়ায় রয়নেল ডি কস্টা, ক্লিফোর্ড ডি কস্টাদের বাড়ি। শেষের দুজনই ছিলেন আমাদের শিক্ষক। বড়দিনে তাঁদের বাড়ির বাইরে রঙিন কাগজের ঝালর ঝুলত। বাইরে থেকে ভেসে আসত গানের শব্দ। কিন্তু সাহস করে কখনো ভেতরে ঢোকা হয়নি।

আমি তো বটেই, ম্যানুয়েলও ভয় করতো স্যারদের। বিশেষ করে ক্লিফোর্ড স্যার ছিলেন ভীষণ রাগী। ইংরেজি পড়াতেন ব্রিটিশ অ্যাকসেন্টে। আমাদের বোঝার জন্য প্রতি বাক্যের পর থামতেন নিয়ম অনুযায়ী। এর মধ্যে লিখতে পারছি না বুঝতে পারলে তাকাতেন অগ্নিদৃষ্টিতে। খাতা দেখার আগেই শাস্তির ভয়ে তখন অর্ধেক হজম হয়ে গেছি। তবু যখন শুনতাম, কোনো ছাত্র বড়দিনে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কেক খেয়ে এসেছে, ভীষণ হিংসা হতো। আর ছাত্রটিও কয়েক দিন হলেও কলারটা উঁচু করে রাখতো। 

কলেজে পড়ার সময় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল উজ্জ্বল। তার সুবাদে পাথরঘাটার ডমিনিক স্যামসন আর কনরাড ডায়াসের সঙ্গে বন্ধুত্ব। ডমিনিক ও কনরাড দুজনই ছিল অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। তাদের সঙ্গেই আমার প্রথম পাথরঘাটায় যাওয়া।

কলেজ থেকে বের হয়ে আমি, উজ্জ্বল, ডমিনিক আর কনরাড পাথরঘাটার ‘পবিত্র জপমালার রানী গির্জা’র পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি কতবার। গির্জার পাশে সেন্ট প্লাসিডস স্কুল আর ক্যাথলিক ক্লাব। পরস্পরের সঙ্গে আমরা কথা বলতাম চাটগাঁইয়া ভাষায়। আর কনরাড ও ডমিনিক ইংরেজিতে। আমি আর উজ্জ্বল ঠাট্টা করতাম এ নিয়ে। উজ্জ্বল বলত, ‘গো বাজার ব্রিং পটেটো আই উইল মেক ইউ আলু ভর্তা’। বড়দিনে ডমিনিকের বাসায় ফল, ঘন ক্রিম আর বাদাম দেয়া কেক খেয়েছি। তেমন কেক আর কোথাও খাইনি।

ডমিনিকদের মতো পাথরঘাটার পুরোনো খ্রিষ্টান বাসিন্দাদের বেশির ভাগই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। পরে বিয়েশাদির সুবাদে নোয়াখালী আর বরিশালের খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্যরাও এখানে স্থায়ী হয়েছেন। তাঁদের তৈরি ব্রিংকা আর দদুল পিঠা এখন বড়দিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এছাড়া আছে রেড বাটার কেক, চকলেট কেক, নানান ফলের তৈরি ফ্রুট কেক। পোলাও, মাংস, কোরমা, সালাদ তো থাকেই। বিশেষ ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে আছে মাংসের পদ ভিন্দালু আর মিষ্টি খাবার কালকাল। এ দুটিই পর্তুগিজ খাবার। বাটা মসলা, ভিনেগার, পেঁয়াজ-রসুন দিয়ে রান্না করা ভিন্দালু ভারতীয় উপমহাদেশজুড়ে এখন জনপ্রিয় এক খাবার।
 
শৈশব আর যৌবনের দিনগুলোয় বড়দিনে আমাদের সন্ধ্যা কাটতো পাথরঘাটায়। পাড়ার সরু রাস্তা ধরে একটা অন্য রকম সুবাস। বাতির ঝলক। ইংরেজি সিনেমায় দেখা বড়দিনের জমজমাট উৎসব সেখানে নেই। তবু যা আছে, তাতেও পাথরঘাটা অতুলনীয়। ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই পাথরঘাটার বাড়িরগুলোর সামনে দেখা মেলে সুসজ্জিত ক্রিসমাস ট্রি, যিশুর জন্মস্থান নাজেরেথের গোয়ালঘরের অনুকরণে তৈরি বাঁশের চৌকোনা বাক্স।

বড়দিন মানেই তো ‘জিঙ্গেল বেল জিঙ্গেল বেল’ গানের চেনা সুর। পাথরঘাটায় পয়লা ডিসেম্বর থেকেই এই সুর শোনা যাবে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে চলে ঘরে ঘরে ক্রিসমাস ক্যারল। একেক দিন একেক বাড়িতে গানের দল আসে। সুর করে সবাই মিলে গায়, ‘শৃঙ্খল বন্ধন চূর্ণিতে/যিশু এল রে এই গোয়ালঘরে’, ‘আজ এল এই বড়দিন প্রাণে আজ বাজে বিন’।

শিশুমঙ্গল, সিএসও, ওয়াইডব্লিউসিএ, বরিশালের দল, নোয়াখালীর দল নামের বেশ কয়েকটা গানের দলও আছে এলাকায়। বড়দিনের আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান শোনান এসব দলের শিল্পীরা।

ছোটবেলায় বড়দিন উৎসব যেমন দেখেছি, এখনো তা খুব বেশি বদলেছে বলে মনে হয় না। তবে এখন পাথরঘাটায় গেলে টের পাই ছোট এই খ্রিষ্টানপল্লিতে অনেক বৈচিত্র্য। ইংরেজ, পর্তুগিজ ও বাঙালি সংস্কৃতি মিলেমিশে বহুজাতিক চেহারা নিয়েছে এখানে।

ডমিনিকের কথাই ধরা যাক। তার বাবা জেভিয়ার স্যাম্পসন মাদ্রাজি ও মা ড্রেটা সাদারল্যান্ড ব্রিটিশ। ড্রেটা কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিটের মেয়ে। সেখানেই জেভিয়ারের সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে। বিয়ের পর ১৯৪৮ সালে স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। ছোটবেলার বন্ধু ডমিনিক এখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বড় কর্মকর্তা। স্ত্রী স্যান্ড্রা স্যাম্পসন বরিশালের মেয়ে। বাড়িতে বাংলা, ইংরেজি দুই ভাষায়ই চলে। খাবারের পদেও হয়েছে দুই জেলার মেলবন্ধন। বৈচিত্র্য নিয়েই তো পাথরঘাটা। আর বাংলাদেশও যে সেই বৈচিত্র্যেরই দেশ।

আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

জনগণ এখন প্রতিবাদ করতে শিখেছেঃ দুদক চেয়ারম্যান
ইবিতে এন্টি র‍্যাগিং ও যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক সভা
পরিচয় মিলেছে মেডিকেল পার্কিংয়ের প্রাইভেট কারে পাওয়া দুই মরদেহের
৩০০ আসনেই ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী চূড়ান্ত
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় এনসিপির চার নেতার ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

আটলা গ্রামের তরুণ যুবকদের উদ্যোগে কৃতি শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
পানির দাবিতে পল্লবীতে কালশী রাস্তা অবরোধ বিহারী ক্যাম্পবাসীর
নির্বাচনে অংশ নেওয়া ভুল হয়ে থাকলে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাই: চুন্নু
সংস্কার, বিচার ও জুলাই সনদে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণাকে ‘ষড়যন্ত্র’ বললেন নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী
স্ত্রীকে মেরে ফেলেছি, আমাকে নিয়ে যান— ৯৯৯–এ স্বামীর ফোন
মতামত- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝