শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫,
১ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
ই-পেপার

শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫
বিশেষ সংবাদ
তামাকের প্রভাব এবং মুখগহ্বরের ক্যান্সার: স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রতিরোধের উপায়
ডাঃ উম্মে হাবিবা
Publish: Wednesday, 25 December, 2024, 5:49 PM  (ভিজিট : 363)

বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে  এবং তার প্রভাব মুখগহ্বরের স্বাস্থ্যের জন্যও  অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তামাক ব্যবহারের কারণে মুখগহ্বরের নানা রোগ যেমন দাঁতের ক্ষয়, মাড়ির রোগ এবং মুখের ক্যান্সার হয়ে থাকে। যার চিকিৎসা না করা হলে জীবনহানি পর্যন্ত ঘটাতে পারে। 

এই প্রভাবের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য অনেকেই বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। তবে, এখনও জনগণের মধ্যে তামাকের প্রভাব নিয়ে সচেতনতার অভাব লক্ষ্য করা যায়। ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান এবং কিছু মুখগহ্বর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে এই প্রতিবেদনটি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও) এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৮ মিলিয়ন মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে মারা যান। তামাকের মধ্যে থাকা নিকোটিন, টার এবং অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান মুখের স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে, যার মধ্যে মুখগহ্বর ক্যান্সার একটি প্রধান কারণ। 

বাংলাদেশে, প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ তামাক ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে প্রাণ হারান এবং ৬১ হাজারেরও বেশি শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত রোগে ভুগছে।এছাড়া, দেশে প্রায় ৩৫.৩% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন, এর মধ্যে ৪৬% পুরুষ এবং ২৫.২% নারী।

তামাক ব্যবহারের পর এটি শরীরে একাধিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তামাক মুখের মিউকোসাল টিস্যু (লসিকা) এবং দাঁতের এনামেল (দাঁতের বাইরের স্তর) ধ্বংস করতে শুরু করে। এর ফলে দাঁত পড়া, মাড়ির প্রদাহ, পিরিওডোনটাল ডিজিজ (মাড়ির রোগ) এবং মুখের ক্যান্সার হতে পারে। 

তামাকের মধ্যে থাকা অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান যেমন বেনজোপাইরেন, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি সরাসরি মুখের কোষের গঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধোঁয়া বা তামাকের পানীয় বা খাওয়া ক্যান্সারের ঝুঁকি দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। মুখগহ্বরের ক্যান্সার প্রথমদিকে সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না, তবে এটি যখন শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা চিকিৎসার জন্য আরও কঠিন হয়ে যায়।

এই প্রতিবেদনে আমরা কয়েকজন মুখগহ্বর ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি, যারা তামাক ব্যবহারকারী ছিলেন। এবার তাদের অভিজ্ঞতা শোনা যাক:

মোহাম্মদ রাহিম (৪৮), ঢাকার একজন বাসিন্দা, যিনি ২০ বছর ধরে সিগারেট খেতেন। তিনি  বলেন, "আমার মুখে ছোট একটা ক্ষত হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রথমে ভাবিনি, কিন্তু এটি দীর্ঘসময় ধরে বাড়তে থাকে। শেষপর্যন্ত ডাক্তার পরীক্ষা করলেন এবং জানালেন যে এটি মুখগহ্বর ক্যান্সার। তামাক আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি এখনও চিকিৎসা নিচ্ছি, তবে এটি পুরোপুরি ভালো হবে কিনা জানি না।"

সুমন (৫৫) আশুলিয়া,ঢাকার বাসিন্দা বলেন, "আমি বিড়ি খেতাম প্রায় ১৫ বছর। কিছু দিন আগে, মাড়ি থেকে রক্ত পড়তে শুরু করল। ডাক্তার বললেন, এটি তামাক সেবনের কারণে মাড়ির সমস্যার লক্ষণ। এখন সিগারেট বা বিড়ি ছাড়তে পারছি না, কিন্তু আমি সচেতন হয়েছি। আর যখন দেখি তামাকের কারণে অন্য রোগীদের দুর্ভোগ, তখন মনে হয় নিজের জন্য কিছু করতে হবে।"

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও)  এবং বাংলাদেশ সরকার কিছু কার্যক্রম শুরু করেছে তামাকের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য। তামাক ব্যবহার বন্ধের জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন চলছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছে। যার মাধ্যমে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

তবে, এসব আইন এবং ক্যাম্পেইনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এবং শহরাঞ্চলের কিছু স্থান এখনও তামাক ব্যবহার নিয়ে সচেতন নয়। এমনকি, কিছু অঞ্চলে তামাকের কুফল সম্পর্কে সঠিক তথ্যও পৌঁছাচ্ছে না।

তামাকের ব্যবহারের ফলে শুধু স্বাস্থ্যের উপর নয়, সমাজের উপরও প্রভাব পড়ে। বাংলাদেশের অনেক এলাকায় তামাক উৎপাদন একটি বড় শিল্প, এবং এর সাথে যুক্ত মানুষের সংখ্যা অনেক। এই কারণে, তামাক ব্যবহারকারী এবং উৎপাদকদের মধ্যে তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়াও, বাংলাদেশের বেশিরভাগ শহরে হাই-স্কুল এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা ও তামাক সেবনে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এসব শিক্ষার্থী তামাকের প্রভাব এবং তার ফলাফল সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন নয় এবং এর ফলে ভবিষ্যতে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। 

তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করতে হলে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:

প্রাথমিক লক্ষণ চেনা: মুখে দীর্ঘস্থায়ী ঘা, লাল বা সাদা দাগ দেখা দিলে অবহেলা না করে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া।

তামাক ত্যাগের উদ্যোগ: তামাক ছাড়ার জন্য বিভিন্ন সেবা ও ওষুধ গ্রহণ করা।

পারিবারিক সচেতনতা: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তামাক সেবনের ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করা।

শিক্ষা ও প্রচারণা: স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে তামাকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম পরিচালনা করা।

মুখগহ্বর ক্যানসার একটি ভয়াবহ রোগ, যা সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তামাক সেবন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করাই এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং জনসাধারণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তামাকমুক্ত একটি সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। 

সচেতনতাই বাঁচার উপায় – তাই আসুন, তামাকমুক্ত জীবনের জন্য শপথ করি এবং সুস্থ জীবনের পথ বেছে নিই।

ডাঃ উম্মে হাবিবা
ডেন্টাল সার্জন ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ



আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

হাসিনার রায়ের দিন বিশৃঙ্খলা ঠেকাবেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: আমির খসরু
যৌন হয়রানির মামলায় ঢাবি শিক্ষক হালিম কারাগারে
মো.পুর জেনেভা ক্যাম্প থেকে ৩৫টি ককটেলসহ বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার
সারাদেশে বিচারকদের নিরাপত্তার দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি
আইএমএফের প্রতিনিধিদল এনসিপির সঙ্গে বৈঠক
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

আ’লীগের ঢাকায় ‘লকডাউন’ কর্মসূচি,সর্তক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
সাঈদ খোকনসহ ৩জনে বিরুদ্ধে ৫৪ কোটি টাকার মানিলন্ডারিং মামলা দুদকের
অপহ্নত ক্যামব্রিয়ান শিক্ষার্থী সুদীপ্তর লাশ উদ্ধার,গ্রেপ্তার-২
দিল্লি হামলার বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবি সঠিক নয়: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
রাজশাহীতে বিচারকের বাসায় ঢুকে ছুরিকাঘাতে ছেলেকে হত্যা
বিশেষ সংবাদ- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান

ব্যবস্থাপনা সম্পাদকঃ মাসুদ আলম
প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik$gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝