সরকারের সকল সেক্টরে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে দাপটের সঙ্গেই আছেন সাবেক সরকারের কর্মকর্তারা।এমনকি নানা অনিয়মের অভিযোগ খোদ মহাপরিচালক খন্দকার মুস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত হিসেবে। আর একারনেই আগের সরকারের অনুচরা মোটা অংকের সুবিধা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন পছন্দের স্থানে বদলি। আর বঞ্চিত ও সংস্কারের পক্ষের কর্মকর্তাদের বদলি করা হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এরই ধারাবাহিকতায় নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এদিকে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে আউটসোর্সিংয়ের ৩১৪টি পদে নিয়োগের টেন্ডার ড্রপিং নিয়ে গত ১৬ অক্টোবর প্রকাশ্যে অনিয়মের বিষয় ধরা পড়লেও কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে দাবি ভুক্তভোগিদের। এমনকি মহাপরিচালক নিজেই টেন্ডার পাইয়ে দেয়ার জন্য নিজের পছন্দের নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নেন বলেও জানান টেন্ডার বঞ্চিতরা।
কুমিল্লার তিতাস এন্টারপ্রাইজের সত্বাধিকারি মইনুদ্দিন খান তিতাস নামের এক এক কথিত বিএনপি নেতার প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য মহাপরিচালকের নির্দেশেই অতিরিক্ত পরিচালক শওকত এবং সহকারি পরিচালককে পাঠান টেন্ডারে অংশগ্রহনকারী অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে নিবৃত করতে। এসময় স্থানীয় ও মূলধারার বিএনপি’র নেতা-কর্মীরা টেন্ডার জমা দিতে না পারায় মারধোর করে তিতাসসহ অন্যান্য টেন্ডার জমা দিতে আসাদের।
এদিকে সহাকারি পরিচালক হিসেবে সাজেদুল গতকাল সোমবার ডিএনসি (দক্ষিণ) যোগদান করেছেন। তবে তার অতীতের সাথে জড়িত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সহ সভাপতির পদবী। এছাড়া গত সপ্তাহে আলোচিত তিন মডেল কন্যার মাদক মামলার বাদী ঢাকা উত্তরের সহকারি পরিচালক রাহুল সেনকে বদলী করে সংযুক্ত করা হয় সদর দপ্তরে। আর পুরষ্কার হিসেবে মহাপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান নিজ জেলার প্রমোটি এক অধস্তন কর্মকর্তা মো. এনায়েত হোসেনকে দায়িত্ব ভার অর্পন করা হয় এক ভারপ্রপ্ত সহকারি পরিচালক ঢাকা উত্তর হিসেবে। তবে সরকারি বিধি মোতাবেক এইপদে কোন সরাসরি কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকা অবস্থায় কোন প্রমোটিকে পদায়িত করার বিধান নাই।
টেন্ডার বঞ্চিত ঠিকাদররা বলছেন, অধিদফতরের পক্ষ থেকে তাদের সময় দেয়া হয়েছিল সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা। তারা যথাসময়ে উপস্থিত হলে তাদের ওপর হামলা চালায় একদল সন্ত্রাসী। তাদের টেন্ডার জমা দিতে পৌঁছার পর তারা বাধা প্রদান ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। আগে থেকেই এক সহকারী পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালক শওকত হোসেনের যোগসাজশে খোদ মহাপরিচালককে ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে তিতাস এন্টারপ্রাইজ কাজ বাগিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন সাধারণ ঠিকাদাররা। এ বিষয়ে মহাপরিচালককে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টি অসত্য বলে এড়িয়ে এড়িয়ে যান।
অন্যদিকে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার প্রশাসন থেকে একাধিক সুবিধা নেয়া ডিজি বদলি বাণিজ্যের বিশাল এক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ খোদ অধিদফতরের কর্মকর্তা কর্মচারিদের। সিন্ডিকেটের সদস্যরা বদলিসহ নানান ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ঘুষ আদায় করে। যার বেশির ভাগই বিগত সরকারের সরকারের সুবিধাবঞ্চিত কর্মকর্তা কর্মচারী। আবার আওয়ামী সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ইতোমধ্যে যাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন তারা পছন্দমতো জায়গায় বদলির জন্য চাপ দিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে বদলি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু অবৈধ পন্থায় বদলি করা চরম অন্যায়। ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার রেখে যাওয়া অনুসারীরা রয়ে গেছে এ সংস্থায়। পতিত সরকারের আস্থাভাজন আমলা হিসেবে পরিচিত মহাপরিচালক খন্দকার মুস্তাফিজুর রহমানের এলাকার বাসিন্দা প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মিলে গড়ে তুলেছেন এই সিন্ডিকেট। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হওয়ার কারণে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভোলা ও নোয়াখালী জেলায় ডিসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জেলাপর্যায়ে বিরোধী দল এবং ভিন্নমতের জনগণের ওপর স্টিম রোলার চালানোর পুরস্কার হিসেবে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই কর্মকর্তাকে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়।
জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে কর্মকালীন সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয়করণ থেকে শুরু করে ভিন্নমতের মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন এবং মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সরকারবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে তার অধীনস্থ জুনিয়র এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ কর্মকর্তারা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রজনতার আন্দোলনকে নিষ্ঠুরতার সাথে দমন করেন। নোয়াখালী জেলার ডিসি থাকা অবস্থায় তার অত্যাচার, নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ওই অঞ্চলের মানুষের হৃদয়ে দাগ কেটে রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, স্বৈরাচারী সরকারের এই কর্মকর্তা শেখ হাসিনার পুরস্কার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের পদ বাগিয়ে নেন। এরপর ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনিভাবে অত্যন্ত লোভনীয় মূল্যবান দুটি প্লট এবং একটি ফ্ল্যাট বাগিয়ে নিয়েছেন, যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ২০ (বিশ) কোটি টাকা। সেখান থেকে নিয়োগ পান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে। এখানে আসতে শেখ হাসিনার আশীর্বাদের পাশাপাশি তাকে অঢেল টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। স্বৈরচারী সরকারের পতনের সাথে সাথেই ভোল পাল্টে নিজেকে বিএনপি, জামায়াতের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করেছেন বলেও জনশ্রুতি রয়েছে।
এদিকে গত ৮ সেপ্টেম্বর জারি করা এক বদলির আদেশ ঘিরে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছেন অধিদপ্তরের এই মহাপরিচালক। এ-সংক্রান্ত আদেশে এক পরিদর্শককে যশোর পণ্যাগারে পোস্টিং দেওয়া হয়। অথচ এই পরিদর্শকের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ঠিক একইভাবে যশোর পণ্যাগারও অবৈধ লেনদেনের হাট হিসেবে পরিচিত। প্রজ্ঞাপনকৃত বদলি আদেশে প্রাইজ পোস্টিং পাওয়া পরিদর্শকদের বেশিরভাগই ১৩ ব্যাচে নিয়োগপ্রাপ্ত। একই ব্যাচ থেকে একসঙ্গে এতজনের পদায়ন নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে একটি স্বচ্ছ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদো বদলি করা হয়েছে। মফস্বল এলাকা থেকে ঢাকায় আনা হয়েছে অনেককে। এর আগে কয়েকজন সহকারী পরিচালককে বদলি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, পরিদর্শকরা প্রধান কার্যালয়ের গুটিকয়েক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, দুষ্ট লোকেরা সবসময়ই তাদের কর্মকাণ্ড চালাবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বদলির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিন সদস্যের কমিটি রয়েছে এ বদলির প্রক্রিয়ায়।
আ. দৈ/এমআই