বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনার নজির স্থাপন করতে যাচ্ছে বিচারিক আদালত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পতীত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,সাবেক স্বারষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামনবতা বিরোধী অপরাধের মামলার রায় অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে সরাসরি বিটি ও বিটি ওয়াল্ডে সম্প্রাচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সাথে রাজধানী গুরুত্বপূর্ন স্থানে বড় পর্দায় সরাসরি রায় ঘোষণা দেখানো হবে।
আগামীকাল সোমবার (১৭ নভেম্বর) ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বিচারিক আদালত উক্ত মামলার রায় ঘোষণা করবেন। রায়ের সময় পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবেন বিচারিক আদালত (ট্রাইব্যুনাল)। কারণ সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুন করাবন্দি। আর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,সাবেক স্বারষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। ঐতিহাসিক এই মামলায় ট্রাইব্যুনালে ৫৪ জন সাক্ষী দিয়েছেন।
মামলায় পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে গণহত্যার উসকানি, মারণাস্ত্র ব্যবহার, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যা, চানখারপুলে হত্যা ও আশুলিয়ায় হত্যারপর ৫ লাশ পোড়ানো। রায় উপলক্ষে ঢাকা, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুর জেলার সার্বিক নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিশেষ টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড রোধে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
এদিকে আজ রোববার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম এক ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান ।তিনি আরো জানান, রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার চ্যানেল বিটিভি ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একযোগে ‘রায় ঘোষণা’ এবং সম্প্রচার করা হবে। একই সঙ্গে রয়টার্সও বিটিভি থেকে নিয়ে সরাসরি সম্প্রচার করবে বলে জানা গেছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাংবাদিকদের বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কোনো ধরনের সহানুভূতি দেখানো হবে না । প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামীম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আসামিদের অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছি এবং সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছি।’
আসামি নারী হিসেবে রায়ের ক্ষেত্রে কোনো অনুকম্পা থাকবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তামিম বলেন, সাধারণ আইনে জামিন প্রদানের ক্ষেত্রে নারী, অসুস্থ ও কিশোরদের কিছুটা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কিন্তু রায়ের ক্ষেত্রে সাধারণ আইনেও তেমন কিছু নেই, এই আইনেও নেই। অর্থাৎ রায় প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি নারী হোক বা পুরুষ, সেটা দেখা হয় না। অপরাধের তীব্রতা বিবেচনা করে রায় দেওয়া হয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে নারী হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। অপরাধের গ্র্যাভিটি বিবেচনা করেই শাস্তি দেওয়া হবে। মামলা অপরাধ প্রমাণ না হলে তাকে খালাস দেওয়া হবে।
উল্লেøখ্য,গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলার রায় ঘোষণার দিন ঠিক করেন। ওইদিন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আদালতে আবেদন করেছেন।আদালত সুবিবেচনা করবেন বলে তাদের বিশ্বাস। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী চিফ প্রসিকিউটর বলেছেন,আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করেন।
২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে শেখ হাসিনা ছাড়াও মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান আদালতে উপস্থিত হয়ে আত্মসমর্পণ না করায় তাদের পলাতক ধরা হয়েছে। সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন ‘অ্যাপ্রুভার’ বা রাজসাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলায় ৫ অভিযোগ প্রমাণীত :
মামলায় পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আবেদন করেছে প্রসিকিউশন। অন্যদিকে, আসামিদের নির্দোষ দাবি করে খালাস চেয়েছেন তাদের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। এছাড়া, রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনেরও খালাস চেয়েছেন তার আইনজীবী।
এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এস. এইচ. তামীম শুনানি পরিচালনা করেছেন। অন্যান্য প্রসিকিউটর ছিলেন বি. এম. সুলতান মাহমুদ, শাইখ মাহদি ও আবদুস সাত্তার পালোয়ান।
পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন শুনানি করেন। রাজসাক্ষী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ।
ঐতিহাসিক এই মামলায় মোট ৫৪ জন সাক্ষী দেন। এদের মধ্যে আছেন গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের পিতাসহ পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক ও জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নাহিদ ইসলাম এবং দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান স্টার উইটনেস হিসেবে সাক্ষ্য দেন।
গত ১০ জুলাই শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। একপর্যায় দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্যতা উদঘাটনে (অ্যাপ্রোভার) রাজসাক্ষী হন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
গত ২৩ অক্টোবর এ মামলায় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সমাপনী বক্তব্যে বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ হেভিওয়েট নেতাদের যেভাবে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, সেসব বর্ণনা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন তিনি। একইসঙ্গে শেখ হাসিনা ও কামালের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন।
পরে আসামিপক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর যুক্তি উপস্থাপনের কয়েকটি বিষয়ে জবাব দেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর তাদের কিছু কথার পাল্টা উত্তর দেন স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী আমির হোসেন। পরে রায়ের তারিখ ঘোষণার জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। এর সপ্তাহখানেকের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার রায় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে জুলাই গণহত্যার প্রথম কোনো রায় শুনবে জাতি।
পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে উসকানি, মারণাস্ত্র ব্যবহার, আবু সাঈদ হত্যা, চানখারপুলে হত্যা ও আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানো। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ মোট আট হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে তথ্যসূত্র দুই হাজার ১৮ পৃষ্ঠার, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণাদি চার হাজার পাঁচ পৃষ্ঠার ও শহীদদের তালিকার বিবরণ দুই হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠার। সাক্ষী করা হয়েছে ৮৪ জনকে। গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে এ মামলার প্রতিবেদন জমা দেয় ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
এদিকে আজ রোববার অন্তর্বর্তীকালনি সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আগামীকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানাল মানবতা বিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা,সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করবেন।ওই রায় অবশ্যই বাস্তবায়ন ও কার্যকর হবে। গতকাল রোববার দুপুর ২টায় বরিশাল পুলিশ লাইন্সে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ মাঠ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।
আ. দৈ./কাশেম