বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫,
১ শ্রাবণ ১৪৩২
ই-পেপার

বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
প্রযুক্তির আসক্তি শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
মির্জা নাদিম :
Publish: Friday, 16 May, 2025, 4:45 PM  (ভিজিট : 246)

বাংলাদেশ গত এক দশকে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের বিস্তার আমাদের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু এই অগ্রগতির বিপরীতে রয়েছে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। প্রযুক্তির প্রতি তরুণ প্রজন্মের অতিরিক্ত নির্ভরতা ও আসক্তি। বিশেষ করে কিশোর ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখন মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এমন এক ভার্চুয়াল জগতে ঢুকে পড়েছে, যা তাদের শিক্ষাজীবন, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।

প্রযুক্তির ফাঁদে পড়াশোনার ক্ষয় : মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের অনেক শিক্ষার্থী এখন দিনের ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায় স্মার্টফোনের স্ক্রিনে। গেমস, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার ও অন্যান্য অ্যাপে ডুবে থাকে তারা। শিক্ষকদের অভিযোগ, শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ কমে যাচ্ছে, পাঠ্যবইয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশের একাধিক সমীক্ষা ও গবেষণায় দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬৭ শতাংশ প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা মোবাইল ব্যবহার করে, যার বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয় বিনোদন বা সামাজিক যোগাযোগে।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ( বিআইডিএস) ২০২৩ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব শিক্ষার্থী দিনে ৪ ঘণ্টার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তাদের পরীক্ষার ফলাফল তুলনামূলকভাবে খারাপ হচ্ছে। একই সঙ্গে তারা সময়মতো ঘুমায় না, সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে এবং স্কুলে অনিয়মিত হয়ে পড়ে।

মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব: মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রযুক্তি-আসক্তি শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিভাগের এক জরিপে উঠে এসেছে, ১৪-১৭ বছর বয়সী শহুরে শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা, রাগ, হতাশা এবং একাকীত্বের লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে, যার একটি বড় কারণ গ্যাজেট আসক্তি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সানজিদা হক বলেন, “বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তারা যদি ভার্চুয়াল জগতের কৃত্রিম রোমাঞ্চে ডুবে যায়, তাহলে বাস্তব জীবনের দক্ষতা, সহমর্মিতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ। এসব গুণ অনুপস্থিত থেকে যায়।”বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমের ফলে শিশু ও কিশোরদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, চোখের সমস্যা দেখা দেয় এবং তারা স্বাভাবিক সামাজিক যোগাযোগে অনাগ্রহী হয়ে পড়ে।

পারিবারিক সংযোগের দূরত্ব : করোনা মহামারির সময় অনলাইন ক্লাস চালু হওয়ায় অভিভাবকরা বাধ্য হয়েই সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন। কিন্তু সেই সাময়িক সমাধান এখন স্থায়ী অভ্যাসে রূপ নিয়েছে। অনেক অভিভাবক এখনো ভাবেন, সন্তান ঘরে আছে মানেই নিরাপদে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা ঘরেই বিভিন্ন অশ্লীল কনটেন্ট, সহিংস গেমস এবং অনুপযুক্ত ভিডিও দেখে নিজের মানসিক বিকাশে মারাত্মক ক্ষতি করছে। একই সঙ্গে, প্রযুক্তির কারণে পরিবারে কথোপকথনের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। ‘ডিজিটাল ডিভাইস বনাম পারিবারিক সময়’ বিষয়ে ব্র্যাক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ বাবা-মা সন্তানের সঙ্গে দৈনিক গড়ে মাত্র ৩০ মিনিট মানসম্পন্ন সময় কাটান।

সামাজিক কাঠামোর ব্যর্থতা: এই সমস্যা কেবল ব্যক্তিগত বা পারিবারিক নয়, এটি এক ধরনের সামাজিক ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। প্রথমত, আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। বিদ্যালয় পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চার ক্লাব, নাট্যদল বা বিতর্ক সংগঠনের সংখ্যা নগণ্য। দ্বিতীয়ত, নগরায়নের ফলে শিশুদের খেলার মতো উন্মুক্ত মাঠ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম বা রাজশাহীর মতো শহরগুলোতে শিশুবান্ধব পার্ক বা খেলার মাঠের সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। তৃতীয়ত, অভিভাবকদের ব্যস্ত জীবনধারা সন্তানদের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ গড়ে তুলতে বাধা দিচ্ছে। স্মার্টফোন তাই হয়ে উঠছে ‘নতুন অভিভাবক’। যা কখনো কখনো হয়ে উঠছে হুমকি।

সমাধানের পথ: সমন্বিত উদ্যোগ দরকার: এই সংকট থেকে উত্তরণে কেবল উদ্বেগ নয়, প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ। . অভিভাবক সচেতনতা ও সংলাপ: প্রথমত, অভিভাবকদের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের ভালো ও খারাপ দিক সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো জরুরি। স্মার্টফোন সন্তানকে শান্ত রাখার উপায় হতে পারে না, বরং তা একটি অশান্ত ভবিষ্যতের ভিত্তি হতে পারে। সন্তান কী ধরনের কনটেন্ট দেখছে, কত সময় ব্যবহার করছে। এ বিষয়ে নিয়মিত সংলাপ ও সহমর্মিতার মাধ্যমে অভিভাবকদের নজরদারি বাড়াতে হবে।

 শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল নীতিমালা: প্রযুক্তিকে একেবারে বাদ দেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ডিজিটাল শিক্ষার জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা জরুরি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালে একটি ‘ডিজিটাল লিটারেসি কারিকুলাম’ চালুর পরিকল্পনা করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীদের প্রযুক্তির ইতিবাচক ও নিরাপদ ব্যবহারের শিক্ষা দেওয়া হবে। এ ধরনের উদ্যোগ আরও বিস্তৃত করতে হবে।
 বিকল্প বিনোদন ও সৃজনশীল চর্চার সুযোগ: শিশুদের জন্য স্থানীয় সরকার বা সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে শিশুবান্ধব মাঠ, পাঠাগার, খেলার কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লাব গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। টেকসই নগর পরিকল্পনায় এই বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা: মিডিয়ারও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, নাটক, তথ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে গ্যাজেট নির্ভরতার নেতিবাচক দিক তুলে ধরা যেতে পারে। বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ প্রধান টিভি চ্যানেলগুলো স্কুল-কলেজ উপযোগী সময়সূচিতে শিশু ও কিশোরদের জন্য গঠনমূলক কনটেন্ট সম্প্রচারে ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রযুক্তি আমাদের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে ঠিকই, কিন্তু এর ব্যবহারে ভারসাম্য না থাকলে তা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারে। আজকের শিক্ষার্থীরা যদি বইয়ের পরিবর্তে গ্যাজেটে ডুবে যায়, তবে আগামী দিনের নেতৃত্ব হবে দুর্বল ও সংবেদনহীন। প্রযুক্তি যেন সহায়ক হয়, নিয়ন্ত্রক নয়—এই বার্তাটি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মিলে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। সময় এখনই। ভবিষ্যৎ বাঁচাতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহারে চাই সচেতনতা, সংযম এবং সমন্বিত পরিকল্পনা।   #  লেখক : মির্জা নাদিম,শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।

আ. দৈ./কাশেম
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

উত্তরাকে ‘গ্রিন বেল্ট’ অঞ্চলে পরিণত করার ঘোষণা ডিএনসিসি প্রশাসকের
একাদশে ২ পরিবর্তন নিয়ে ‘ফাইনাল’ ম্যাচে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
ত্রাণকেন্দ্রে ক্ষুধাত্ব গাজায় হুড়োহুড়িতে নিহত- ২১
ব্লকেড সরিয়ে নিতে নাহিদের আহ্বান
সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ ও নাফিজ পরিবারের ৭১ কোটি টাকা আত্মসাৎ.দুদকের মামলা
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

সর্বজনীন পেনশন স্কিম গতিশিল করতে ১৭ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতা
এনসিপি নেতার ৭ লাখ টাকা নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা: সারা দেশে ব্লকেড কর্মসূচি ঘোষণা
১৬ জুলাই মার্চ টু গোপালগঞ্জ: সারজিস
আদালতে নিজেদের নির্দোষ দাবি করলেন নাসির-তামিমা (ভিডিও)
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি- এর আরো খবর
close
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik$gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝