শহর, নগর কিংবা গ্রামের পরিকল্পনায় শুধুমাত্র বিত্তবানদের প্রাধান্য না দিয়ে দেশের শ্রমজীবীদের নিয়ে পরিকল্পনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। রোববার (১১ মে) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানাের্সর (বিআইপি) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিষয়ক ৪র্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন বক্তারা। ৩ দিনব্যাপী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন রবিবারে “বৈষম্যহীন উন্নয়নে সংস্কার” (“Spatial planning for urban and rural development: agenda for reform towards transition”) শীর্ষক হাই-লেভেল পলিসি গোলটেবিল বৈঠকে এই পরামর্শ উঠে আসে।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, “ষাটের দশকে যে শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে তার সাথে আশির দশকে গড়ে ওঠা শিল্পাঞ্চলের অনেক পার্থক্য। আমাদের শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমজীবীদের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া হয় না। কিন্তু কোনো একটি এলাকার পরিকল্পনা করতে হলে ঐ এলাকার শ্রমজীবীদের বিষয়টি সবার আগে ভাবা উচিত। আশুলিয়াকে কেন্দ্র করে একটি পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার সুপারিশ করেছি কমিশন থেকে।”
তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহর শ্রমজীবী মানুষের শহর না কিন্তু ঢাকায় শ্রমজীবী মানুষের বাস বেশি৷ যার মূলে রয়েছে সঠিক পরিকল্পনার অভাব। এই সংকট সমাধানে উদ্যোগী হতে হবে। নতুন শহর পূর্বাচল গড়ে উঠেছে সেখানে কি শ্রমজীবী মানুষের জন্য বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐক্যমত্য সৃষ্টির চেষ্টা করছি। স্বৈরাচার যাতে ফিরে আসতে না পারে সে অনুযায়ী আইন, ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি। যেগুলোর কারনে স্বৈরাচার সৃষ্টি হয়ে সেগুলো পরিবর্তনের জন্য যেসকল বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার সে বিষয়ে সুপারিশ করেছি। তবে রাজনীতিবিদরা চান সেই পরিবর্তন যে পরিবর্তন তাদের ক্ষমতায় নিয়ে যাবে। কিন্তু যে পরিবর্তন সাম্যতা, ন্যায্যতা তৈরি করবে সেটা চান না রাজনীতিবিদরা।”
তিনি বলেন, “দলগুলো থেকে এরকম প্রস্তাব এসেছে যে সংসদে উচ্চকক্ষ হবে কিন্তু নিম্নকক্ষে তাদের যেমন অবস্থান থাকবে উচ্চকক্ষেও তাই হবে। তাহলে সংস্কার কি হবে? নারী আসন ৫০ থেকে ১০০ করার বিষয়ে অধিকাংশই একমত কিন্তু তারা চান এখন যেভাবে হয় সেভাবেই হবে। এখন তো নিজেদের আত্মীয় স্বজন আর টাকা খেয়ে নারী আসন পায়।”পরিবেশ বাসের অযোগ্য করলে কোনো সংস্কার কাজে আসবে না। এজন্য সরকার, সাধারণ মানুষসহ সকলের সচেতন হতে হবে বলে তিনি জানান।
স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনপ্রধান অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, “যখন সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো রেডি হয়েছে তখন রিপোর্টগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ নেই। যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর একাডেমিক ও এক্সপার্ট লোকজনের পেছনে ঘুরার কথা ছিলো সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে সেখানে সংস্কার কমিশন সংস্কারের রিপোর্ট নিয়ে রাজনীতিবিদদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের এখন সংস্কার নিয়ে আগ্রহ নেই।
তিনি আরও বলেন, “লোকাল গভর্নমেন্ট কোনো গভর্নমেন্টই না। কারন লোকাল সংস্থাগুলোর ফাংশন সব সরকারের হাতে। শিক্ষার লোকবল, ফান্ড সব সেন্ট্রাল সরকারের হাতে কিন্তু বিষয়গুলো দেখে উপজেলা প্রশাসন। হাসপাতালোরও একই অবস্থা। জেলা প্লান করার সুপারিশ করেছি আমরা। আমরা জানি না একটা জেলায় কতো বাজেট হয়। আমরা সুপারিশ করেছি যেন এগুলো জনগণের কাছে পরিষ্কার করা হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, “পরিবহন ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হবে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্যের সাথে। সারা বিশ্বের পরিবহন ব্যবস্থা যেভাবে চলছে তার থেকে ভিন্নভাবে চলছে বাংলাদেশ ও ভারতের পরিবহন ব্যবস্থা। সব দেশে রেল, সড়ক, নৌ, বিমান মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় করে পরিচালিত হয় কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে উল্টো।
বাংলাদেশ ইনস্টিউটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এ. কে. এনামুল হক বলেন, “ ঢাকার প্রতি কিলোমিটার রাস্তা প্রতিদিন ৮০ হাজার মানুষ ব্যবহার করেন। নিউমার্কেট মোড়ে ঘন্টায় ৫ হাজার মানুষ ক্রসিং করে। এতো মানুষের মুভমেন্টের জন্য কি ওয়াশরুমের ব্যবস্থা আছে? ঢাকার ফুটপাতের গড় আয়ু দেড় বছর। এর মধ্যেই কাটা হয়, খোঁড়া হয়। আমাদের যা কিছু গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ভাবে। আমাদের প্লান হচ্ছে শহরকে ভবনের বস্তি বানানো। ঢাকা শহর এমন এক শহর যেখানে পর্দা সবচেয়ে বেশি। আমরা ভবনের চেয়ে পাশের বাউন্ডারি দেয়াল বেশি দিচ্ছি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, “বাংলাদেশে যেসকল রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় ছিলো তারা কখনও সামগ্রিক কথা চিন্তা করেনি। বসবাসের অযোগ্য শহর গড়ে উঠার পেছনে তিনটি গোষ্ঠী কাজ করে। তারা হলো আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী-রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী, আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের জন্য অপ্রাসঙ্গিক নানা প্রকল্প কাঁধে চাপিয়ে দেয়। এই তিন শক্তি স্থায়ী সরকার হিসেবে কাজ করে। এই তিনের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলো সমন্বয় করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিলিয়ন ডলার খরচ করে সবুজ ধ্বংস করছি আর বিভিন্ন দেশ বিলিয়ন ডলার খরচ করছে সবুজ বাড়াতে। শ্রমজীবী মানুষ এবং নারীদের প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।জনমত তৈরির জন্য বাংলা ভাষায় স্থানিক পরিকল্পনার বিষয়টি তুলে ধরার আহবান জানান তিনি।
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ফিরোজ আহমেদ বলেন, “আমরা ঢাকাকে মানবিক শহর হিসেবে গড়ে তুলছি না। আমরা যুবকদের শ্রম শোষণ করার জন্য ঢাকাকে গড়ে তুলেছি। ফলে শ্রম দেওয়া শেষ হলে তাদেরকে ঢাকা ছাড়তে হয়। যেকোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থার ব্যক্তিদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা থাকা আবশ্যক।”
বিআইপির সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, “বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংস্কার কমিশনগুলো যে কাজ করছে সেটা অনেক বছর পরে হয়েছে। আমরা উন্নয়ন বৈষম্যের চ্যালেঞ্জে আছি। আমাদের সুষম পরিকল্পনা এবং বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে হাঁটতে হবে।”
বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র ব্যবস্থা চলছে তার মধ্যে কোথাও না কোথাও গলদ আছে ফলে একটি অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। আমরা চাই পরিবর্তিত এই সময়ে দেশের প্লানিং এর রিফর্ম হোক।”
শনিবার (১০ মে) থেকে শুরু হওয়া বিআইপির নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনাবিষয়ক ৪র্থ আন্তর্জাতিক সম্মেলন সোমবারে শেষ হবে। এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য হচ্ছে “নগর, অঞ্চল এবং গ্রামীণ এলাকার বৈষম্যহীন উন্নয়নে স্থানিক (Spatial) পরিকল্পনা।”
আ. দৈ./ কাশেম