তিন ব্যাংকের পর এবার ইউনিয়ন ব্যাংকেরও শীর্ষ খেলাপি দেশবন্ধু গ্রুপ। এর আগে বেসরকারি শরীয়াহভিত্তিক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি’র শীর্ষ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত দেশবন্ধু গ্রুপ। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত চারটি ব্যাংকের শীর্ষ খেলাপিতে পরিণত গ্রুপটি।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির আত্মীয় ও তার প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ। ২০২১ সালে একটি ঋণ নেয় দেশবন্ধু গ্রুপ। এরপর এক বছর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে। তারপর আর খবর নেই। সরকারের পট পরিবর্তনের পর এখন একেবারেই উধাও। এখন সুদে-আসলে ১০০ কোটি টাকার খেলাপি হয়ে নিরুদ্দেশ।
এরআগে দেশবন্ধু গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু সুগার মিলস ২০১৭ সাল থেকে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে ২০১৯ সাল থেকে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসির সঙ্গে এবং ২০২৩ সাল থেকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে। দেশবন্ধু গ্রুপের সাতটি কোম্পানির অনুকূলে মোট তিনটি ব্যাংকের বনানী শাখা থেকে ৪ হাজার ৯৩৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে স্যোশাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮০৭ কোটি টাকা ঋণ নেয় গ্রুপটি।
এর মধ্যে ফান্ডেড ঋণ রয়েছে ৬৭৯ কোটি ৭৬ লাখ। আর নন-ফান্ডেডে রয়েছে ১২৭ কোটি ২১ লাখ। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে, ফুড এন্ড বেভারেজ লি., সুগার মিলস্ লি., দেশবন্ধু সিমেন্ট মিলস., দেশবন্ধু কনজ্যুমার এন্ড এগ্রো লি. ও এম.আর ট্রেডিং। যা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়া দেশবন্ধু গ্রুপটির অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের নামে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার কোটি টাকা এবং ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ঋণ রয়েছে। যা এখন পুরোপুরিই খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। এই গ্রুপটি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি রিপোর্টে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু পরিশোধ করেননি। পরিশোধ না করেই ঋণ মওকুফের জন্য আবদেন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।এতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো প্রকার স্বায় দেয়নি। তাকে স্ব স্ব ব্যাংকে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
তবে এখন সব ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় রয়েছে গ্রুপটি। জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন পরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি দেশ থেকে পালিয়ে দুবাইতে অবস্থান করছেন। বিনা জামানতে আওয়ামী আমলে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ঋণ নিয়েছিলো এই গ্রুপটি। ব্যাংকের টাকা না দিয়ে এই গ্রুপটি শুধু ঋণের সুদ মওকুফ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি চালিয়েছে। কালক্ষেপন করে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে।
ইউনিয়ন বাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোঃ হুমায়ুন কবির বলেন, ‘দেশবন্ধু গ্রুপের ঋণ অর্থ আদায়ে বার বার যোগাযোগ করে যাচ্ছি। তারা দেবে দেবে বলছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অর্থ দেয়নি। খুব দ্রুত অর্থ আদায়ে আরও পদক্ষেপ নেয়া হবে। অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হলে আইনের আশ্রায় নেয়া ছাড়া উপায় নেই।’
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। তার তিনদিন পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর ১৩ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। এরপর ১০ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙ্গে নতুন পর্ষদ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে এই চার ব্যাংকও রয়েছে।
ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী সরকারের ক্ষমতার অব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের প্রতি নজর না দিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। ফলে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে গ্রুপটি। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সিংহভাগ টাকা দুবাইয়ে পাচার করেছে। সেখানে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগও করেছে। এখন তিি দুবাইয়ে আসন গেঁড়েছেন। পাচার টাকায় পাহাড় গড়ে রয়েছেন ধরা ছোয়ার বাইরে। তাই দেশের প্রতিষ্ঠানের উপর তার কোন মমতা নেই। ব্যাংকের টাকা না দিয়ে তালবাহনা করছে। দেশে তার কিছু পোষ্য রীতিমতো তথ্য-আদান-প্রদান করছে।
এ ব্যাপারে দেশবন্ধু গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফাকে হোয়াটস্যাপে একাধিকার বার ফোন ও ম্যাসেজ দিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, তার খেলাপি ঋণ নিয়ে আজকের দৈনিকে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্ট বন্ধ করতে তিনি নানা প্রভাব-প্রতিপত্তির আশ্রায় নেন। এমন কি পত্রিকা অফিসে উকিল নোটিশ পাঠিয়ে মামলা করারও ভয় দেখান তিনি।
র/আ