বাংলাদেশে যখনই সরকার পরিবর্তন হয়, তখন মিডিয়া এবং ব্যাংকের প্রতি সরকারের বিশেষ দৃষ্টি থাকে। সরকারের প্রচারে দরকার মিডিয়া এবং আর্থিক সুবিধা ভোগের জন্য প্রয়োজন ব্যাংক। কথায় বলে, বেশি ব্যাংক বেশি লুটপাট; বেশি মিডিয়া বেশি অপপ্রচার। এ দুটো কাজে আওয়ামী সরকার বিশ্বে এক নম্বর অবস্থানে ছিল। বিগত আওয়ামী সরকারের ১৬ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৬টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়।
বিগত সরকারের রেখে যাওয়া মৃতপ্রায় ব্যাংক খাত এখনো ধুকছে। ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি অর্থনীতির চাকা। কালোটাকার পাহাড় গড়াদের টাকা নানা কারসাজিতে ছাড় করিয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের বিষয় তদন্তনাধিন রয়েছে। কিন্তু মহাবিপাকে রয়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তÑ এসব গ্রাহক যারা ভবিষ্যতে কিছু টাকা সঞ্চয়ের আশায় একসময় ব্যাংকের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তারা এখন সবচেয়ে বেশি বিপাকে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন মানুষও ব্যাংকের দ্বারস্ত হয়েছিলেন ভবিষ্যতে কিছু সঞ্চয়ের আশায়। কিন্তু এখন তারা পথের বিবাগি। দিনের পর দিন ব্যাংকের সামনে বসে থেকেও তাদের সেই টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। রক্তে-ঘামে আয় করা এসব সাধারণ মানুষের জমানো সঞ্চয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাদেরকেই এখন অবহেলা করছে দেশের সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলো।
সরকারি ও বেসরকারি সব মিলে দেশে বর্তমানে ব্যাংকের সংখ্যা ৬০ এর বেশি। এর মধ্যে বেশিরভাগ ব্যাংক নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এবং এদের ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় দুরদর্শিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া রয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের অক্টোবর-নভেম্বরের প্রজ্ঞাপন ২০২৪ এ ২৯ ব্যাংক ইয়েলো জোন এবং ১০ ব্যাংক রেড জোনে আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী আওয়ামী সরকারের আমলে বাংলাদেশে ঋণ ৯৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পাচার হয়েছে ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক এবং বেসরকারি ব্যাংক। বহু আমানতকারী এখন পর্যন্ত তাদের টাকা উত্তোলন করতে পারেনি। এক কথায়, বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাত বড় ধরনের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার সাতমাস অতিবাহিত হয়েছে। গত সাত মাসে বাণিজ্যিক ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন, ব্যাংকিং টাস্কফোর্স গঠন, ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ নানান উদ্যোগ নেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া এসব উদ্যোগের কাঙ্খিত ফলাফল আসেনি। একদিকে ইতিবাচক প্রভাব পড়লে, অন্যদিকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকখাতে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে দীর্ঘ সময় দরকার। ফলে এ সরকারের নেয়া উদ্যোগ পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার আশা ক্ষীণ।
বর্তমানে উচ্চ খেলাপি ঋণে বিপর্যস্ত ব্যাংক খাত। আর এ খেলাপির কারণে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রভিশন তথা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতিও। ভালো এবং মন্দ ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রভিশন তথা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে হয় ব্যাংকগুলোকে। তবে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, একই হারে পরিচালন মুনাফা না বাড়ায় পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে পারছে না সরকারি ও বেসরকারি খাতের বেশ কয়েকটি ব্যাংক। এ তালিকায় বেশ কিছু সবল হিসেবে পরিচিত ব্যাংকের নামও এসেছে। যদিও প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংক দুর্বল হওয়ার সংকেত বহন করে।
পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি না রাখার ফলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মোট প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৫৫ হাজার ৩০০ কোটি টাকারও বেশি। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের ১৩টি ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতি ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি খাতের পাঁচটি ও বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক পর্যাপ্ত প্রভিশন রাখতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিল ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, গত সাত মাসে উল্লেখযোগ্য কোন সংস্কার সাধন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ ব্যাংক ব্যবস্থায় যেসব সমস্যা, তা আগের মতোই রয়ে গেছে। এছাড়া ব্যাংকখাতের যে গুনগত পরিবর্তন আশা করা হয়েছিল, তার তেমন কিছুই হয়নি। যেটা হয়েছেÑ ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম কিছুটা সীমাবদ্ধ করা হয়েছে, পর্ষদগুলোর পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে ইত্যাদি। অর্থাৎ যে বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন দরকার ছিল, তা হয়নি। যার ফলে ফলে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। দুর্বল ব্যাংকগুলো এখনো দুর্বলই রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া এগুলো চলতে পারছে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সাবেক এ মহাপরিচালক বলেন, সামগ্রিকভাবে ব্যাংকখাত এখনো খাদের কিনারেই রয়ে গেছে। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাসে ব্যাংকিং খতের যে ধরনের পরিবর্তন দরকার, সেই প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এবং সংস্কার এখনো কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। বাস্তবতার মুখ দেখেনি। অর্থনীতি ঘুরে দাড়াতে যে ধরনের কার্যক্রম হাতে নেয়া দরকার তা নিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ প্রধান অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, পিছনের সমস্যাগুলো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথটাকে আটকে দিবে। পিছনে ফিরে না তাকালে সামনে আগানো যাবে না। যদি আমরা পিছনে ফিরে না তাকাইÑ তাহলে সংস্কারের আলোচনা করাই বৃথা। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে আমাদের আর্থিকখাতে যে ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থপাচার হয়েছেÑ এসবের জন্য যারা দায়ী, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদই হোক না কেন তাদের প্রত্যেককেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটা না করতে পারলে ভবিষ্যতে যারা দায়িত্ব পালন করবে তারা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধ, মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার বৃদ্ধিসহ আরো কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে গত সাত মাসে। অল্প সময়ের মধ্যে ১১ ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন, একক গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত ব্যাংক খাত, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনা জামানতে প্রবাসীদের ঋণ, একাধিকবার নীতি সুদহার বৃদ্ধি, রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, তিনটি টাস্কফোর্স গঠন, সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয় ব্যাংককে সহায়তা, কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার রোধ করার মতো উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, গত সরকারের সময়ে আমাদের ব্যাংকগুলো থেকে টাকা চুরি হয়েছে। এটা কিন্তু ঘটনাক্রমে হয়নি, এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উৎসাহিত করা হয়েছে বলেই ঘটেছে। তৌহিদ হোসেন আরো বলেছেন, সবাই বলাবলি করছে, অমুক ব্যাংকটাকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। কারণ, একটা ভালো ব্যাংক থেকে সমানে খারাপ ঋণ দেয়া হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যদি সমর্থন না থাকত, তাহলে এটা সম্ভব হতো না।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তার বোঝা পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে তাদের ঘাড়ে বহন করতে হতে পারে। দেশের যত ধরনের ক্ষতি করা যায়, তার সব কিছু করেই তারা (সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা) অর্থ বাইরে (পাচার) নিয়ে গেছেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে যতগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং মোকাবেলা করতে হয়েছে, এরমধ্যে তিনটি খাত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যাংকিং খাত, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। ব্যাংকিং খাতে অনেক বছরের পুঞ্জিভূত সমস্যা রয়েছে। এ খাতকে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক, শক্তিশালী বিভিন্ন ধরনের স্বার্থগোষ্ঠীর কারণে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যেটুকু ক্ষমতা ছিল সেটুকু প্রয়োগ করার অভাবে অনেক বড় ধরনের বিশৃঙ্খার সৃষ্টি হয়েছে। খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২০ হাজার বলা হচ্ছিল, সরকার পরিবর্তনের পর এটা ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি গভর্নর বলেছেন, ৩০ শতাংশ অর্থাৎ খেলাপি ঋণ ৪ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।
এ অর্থনীতি বিশ্লেষক বলেন, ব্যাংকিং খাতে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। খেলাপি ঋণ নিয়ে কী করনীয়; দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় কী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন; ব্যাংক থেকে যে টাকা চলে গেছে তা ফিরিয়ে আনতে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেÑ এ সবগুলোই মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গভর্নর এবং তার সহযোগিরা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। কয়েকটি টাক্সফোর্স করা হয়েছে। চেষ্টা করছেন নানা ধরনের সংষ্কার করতে। তবে আমি মনে করি নির্দেশনার দিক থেকে তারা ঠিক পথেই আছেন, কিন্তু আরো একটু উদ্দোম, উদ্যোগ আমরা আশা করি। কারণ ব্যাংক খাতের সাথে সার্বিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনার স্থিতিশীলতা জড়িত, মূল্যস্ফীতি জড়িত, বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান জড়িত। এ খাত ঠিক না হলে ব্যাংক ঋণে যে ইন্টারেস্ট রেট হবে তা দিয়ে উদ্যোক্তারা ব্যবসা করতে পারবে না। সুতরাং ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনা, সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনয়নের পূর্ব শর্ত। একই সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের পর্ষদে যারা অর্থ পাচারের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।