ছবি টি- গত বছর ২৭ মে.দুপুরের ঢাকা দক্ষিণ সিটির সায়েদাবাদ এলাকায় সড়কে জলাবদ্ধতার
চলে আসছে বর্ষামৌসুম। অতীতের ভয়াবহ জলাবদ্ধতা আর দু’ভোগ নিয়ে এবারও মারাত্মক আতঙ্কে রয়েছেন রাজধানীবাসী। কারণ বৃষ্টি নামলেই বেহাল দশা ঢাকা শহরের। নগরীর অধিকাংশ এলাকাই ময়লা পানিতে তলিয়ে যায়। রাস্তায় ময়লা পানিতে ঢেউ খেলে। মানুষের বাসা বাড়ি, দোকান পাঠ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে রাস্তা গলিপথে বৃষ্টির পানিতে থৈ থৈ করে। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে স্থায়ী উদ্যোাগ নেই, ঢাকার দুই সিটিতে।
কিন্তু এসব দেখার জন্য ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব থাকলেও বর্তমানে তারা নেই। তবে রয়েছেন দুই প্রশাসক। তাদের পক্ষ থেকে জোরোলো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের নামে বড় বড় কথা বলা ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নুর তাসপ রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। আর ঢাকা উত্তর সিটির আরেক চাপাবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত মেয়র আতিকুল ইসলাম পালিয়েও রক্ষা পাননি, বিভিন্ন মামলায় বর্তমানে কারাগারে আটক আছেন।
এদিকে বর্ষামৌসুমে নগরবাসীর দু’ভোগ ও আতঙ্কের যেন শেষ নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে ড. মোহাম্মদ ইউনসের নেতৃত্বার্ধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নগরবাসীর কল্যাণে ও সেবার মান বৃদ্ধির স্বার্থে ঢাকা দুই সিটিতে মেয়রের অবর্তমানে দায়িত্ব পালনে দুইজন প্রশাসককে নিয়োগ দিয়েছেন। কিন্তু তাদের পক্ষ থেকে নগরীর জাবদ্ধতা নিরসনে এখনো জোরালো কোন কর্মসূচি দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র উপদেষ্টাদের ওপর নির্ভর করে সভা সমাবেশ নানা প্রতিশ্রুতি আর সুন্দর সুন্দর কথা বলে যাচ্ছেন। এখনো ঢাকা দুই সিটির প্রকৌশল বিভাগের ড্রেনজ সার্কেলকে কাজে লাগাতে পারেননি। নামে মাত্র ড্রেনেজ রেখেছেন।
অচিরেই ভারী বৃষ্টিতে নগরীর নিম্মাঞ্চলসহ রাস্তা, গলিপথ পানিতে ডুবার পর ওই দৃশ্য দেখার জন্য নেমে আসতে হবে। সারাবছর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রশাসক, প্রকৌশলী এবং কর্মকর্তারা অনেকটা সক্রিয় নেই। সারাবছরই উন্নয়ন মূলক কাজের নামে একই রাস্তা বিভিন্ন সংস্থাকে খঁড়াখঁড়ির সুযোগ করে দেন। অদ্যাবদি নগরীতে একই এলাকায় ও রাস্তা-গলিপথে উন্নয়ন মূলক কাজে সেবা সেক্টরগুলোর সাথে কোন ধরনের সমন্বয় গড়ে তোলতে পারিনি ঢাকার মেয়র/ প্রশাসকগণ।
অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন যাবৎ ঢাকা দুই সিটির নগর পরিবল্পনাবিদ, সংশ্লিষ্ট বেশ কয়জন প্রকৌশলী এবং আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ডজন ডজন কর্মকর্তাদেও নিয়ে মেয়র / প্রশাসকগণ বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সফর করেন। তারা বিদেশ ভ্রমণ এবং সভা, সেমিনারে অংশ গ্রহণ দেখি সরকারের কোটি কোটি টাকা খরচ করেন। কিন্তু ওইসব দেশের আদলে আজো ঢাকা দুই সিটিতে স্থায়ী কোন কার্যক্রম শুরুর নজির স্থাপন করতে পারেনি। তা হলে কেনো কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশ ভ্রমন করা হচ্ছে। এসব বিষয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলে।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সাল, ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে জলাবদ্ধতার ছবি- এটি
এদিকে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান নগরীর জলাবদ্ধতা প্র্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের জন্য পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন দরকার। পূর্ণাঙ্গ ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। সেটা না করে যেটুকু প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল, তাও ধ্বংস করা হয়েছে।’
সরে জমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্ষা মৌষমে নগরীর ভয়াবহ জলাবদ্ধার পেছনে অনেকগুলো বাস্তব কারণ রয়েছে। তারমধ্যে প্রধান কারণ,ভারী বৃষ্টির পানি দ্রুত সরার তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। নগরীর ড্রেনগুলো ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে রয়েছে। ফলে ডেন্রের পানি দ্রুত সরতে পারে না। এছাড়া ড্রেনের পানি সরে যাবে কোথায়, পুরনো বড় বড় খালগুলো প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে এবং ভরাট করে গড়ে তোলেছে অনেক স্থাপনা। ড্রেনের পানি যাচ্ছে রাস্তায় আর রাস্তার পানির যাচ্ছে নগবাসীর বাসা বাড়ি, দোকান পাটসহ নিম্মাঞ্চলে। যদি বৃষ্টির পানি দ্রুত ড্রেন হয়ে খালে এবং খাল থেকে নিকটবর্তী নদীতে কিংবা বড় বড় জলাশয়ে যাবার সুযোগ থাকতো, তাহলে এই নগরীতে জলাবদ্ধতা থাকতো না।
সূত্র মতে, ২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে ঢাকার দুই সিটিকে পুরনো খাল হস্তান্তরের সময় উল্লেখ করা হয় রাজধানীতে মাত্র ২৬টি খাল রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায় ঢাকা উত্তর সিটিতে ৩০টি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৩৯টি খালের সন্ধান পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে ঢাকায় ছোট বড় মিলে মোট ৬৯টি খালের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর দুই সিটি করপোরেশনের নর্দমা রয়েছে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খালগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার পর রুটিন মাফিক উচ্ছেদে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। তা ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে খাল-নর্দমা পরিষ্কার করা হয়। তবে দুই মেয়র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের বাইরে নগরবাসীর দায়িত্বহীনতাকে অনেকটা দায়ী করা হয়।
সূত্র মতে, গত ৫ মার্চ পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে এখানকার খালগুলো খননের বিকল্প নেই। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে আমাদেরকে ঢাকার খালগুলোতে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে এবং এজন্য খাল খনন কার্যক্রম চলমান থাকবে। গত ৫ মার্চ ঢাকা উত্তর সিটির ৬টি খালের খনন কার্যক্রম পরিদর্শনে এসে এসব কথা বলেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ৬টি খাল খননের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং আরো ১৩টিসহ মোট ১৯ খাল খননের কার্যক্রম এ বছরের মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি আরো বলেন, দিন দিন ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
গত ৫ মার্চ ২০২৫ সাল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাউনিয়া ও খিদির খাল পরিদর্শনকালের- ছবি এটি
এ অবস্থায় ঢাকার খালগুলো খনন করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উন্নত হবে। ঢাকার খালগুলো খননের পর খালের পাড়ে দৃষ্টিনন্দন ফুলের চারা এবং ফল ও পাখিদের খাওয়ার উপযোগী বৃক্ষরোপণ করা হবে। গত ১৭ এপ্রিল মোহাম্মদ পুওে পুরনো হাইক্কার খাল উদ্ধারে অভিযানের কথা বলেছেন ঢাকা উত্তর সিটি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। ওইসময় স্থপতি ফজলে রেজা সুমন-সহ ডিএনসিসি ও নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এরআগে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম খাল উদ্ধারে ‘কলাগাছ থেরাপি’র চালু করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘বাড়ির বর্জ্য যেসব পাইপের মধ্য দিয়ে খালে ফেলা হয়, সেই প্রতিটি পাইপে কলাগাছ ঢুকাতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। কারণ কীভাবে বারিধারা, গুলশানের লোকেরা খালের মধ্যে কালো বর্জ্য দিয়ে দিচ্ছে। এটি অত্যন্ত কষ্ট লাগে আমার।’ তবে তিনি বছিলা খালটি উদ্ধার করেছেন। আর মিরপুরে ভাউনিয়াবাধ এলাকায় খাল উদ্দরের চেষ্টা করেছেন।
ওই ডিএনসিসির যত পরিকল্পনা : খালের দায়িত্ব বুঝে নেয়ার পর প্রথমেই সীমানা নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কাজ দেয়া হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে সীমানা নির্ধারণ করা হবে তা নিয়ে দ্বিধা তৈরি হয়। সিএস, আরএস আবার কোথাও মহানগর জরিপ ধরে খালের সীমানা নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ অবস্থায় একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে ডিএনসিসি। টাস্কফোর্স কয়েকটি সভাও করেছে।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , নিকুঞ্জ-জোয়ারসাহারা-রেডিসন টু কাকলী সড়কে জলাবদ্ধতার -ছবি এটি
এখনো সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়নি। অথচ ঢাকা ওয়াসা থেকে খাল বুঝে নেওয়া পর ওয়াসার আগের কিছু জনবল নিয়েছিল ডিএনসিসি। কিন্তু অন্তর্কোন্দল দেখা দেওয়ায় এসব জনবল ওয়াসায় ফেরত পাঠানো হয়েছে। এরপর ড্রেনেজ সার্কেল গঠন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পদ সৃষ্টির প্রস্তাব দেয় ডিএনসিসি। সেই প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রণালয় কোনো ফিডব্যাক এখনো দেয়নি। এ ছাড়া ডিএনসিসি খালগুলোর আধুনিকায়নেও একটি প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। সেই প্রস্তাবও মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে।
অপরদিকে ডিএসসিসি সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস খাল উদ্ধারের নামে অনেক মহড়া দিয়েছেন। তিনি বলতেন ‘খাল দখলের সময় খেয়াল থাকে। জলাশয় আইন অনুযায়ী দখল হওয়া খালের জায়গা উদ্ধার করতে গেলে মানুষের কান্নার রোল পড়ে যাবে। লাঠিপেটা বা তদারকি করে দুর্নীতিমুক্ত হওয়া যায় না। একজন নাগরিক হিসেবে যদি দুর্নীতিমুক্ত হতে না পারি, তাহলে কিছুই হবে না।’ ত্রিমোহনী খাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তার উদ্ধার করা কয়েকটি খাল আবার প্রভাবশালীদের দখলে চলে গেছে। ঢাকা দক্ষিনের ৩৯টি খালের মধ্যে ১৫টিই রয়েছে ডেমরায় ডিএনডি এলাকায়।
এগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এই খালগুলোও ডিএসসিসিকে হস্তান্তরের করা হয়নি। ঢাকার বড় একটি অংশের বৃষ্টির পানি মান্ডা, জিরানী, শ্যামপুর ও কালুনগর খাল হয়ে নিষ্কাশন হয়। ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ খালগুলো আসলে বাস্তবে নেই। আছে কাগজে-কলমে। এসব খাল উদ্ধারে ৮৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। প্রকল্পের কাজ কোথাও কোথাও শুরুও হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ১৮টি খাল বুঝে নেওয়ার পর মাত্র চারটি খাল নিয়ে পরিকল্পনা করে এগিয়েছে সংস্থাটি। বাকি খালগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তবে রুটিন পরিচর্যা না হওয়ায় সেই খালগুলোও আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে উদ্ধার ও খনন ডিএসসিসির ভালো একটি কাজ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যান্য খালের সীমানা নির্ধারণ, দখলমুক্তকরণ এবং অন্যান্য কাজ কবে শেষ হবে তা সংশ্লিষ্টরা বলতে পারছেন না।
ডিএসসিসি নর্দমা ও খালের সঙ্গে নদীর সংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি প্রয়োজনের আলোকে মাস্টার ড্রেন তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। যেটা পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। প্রাথমিকভাবে নিউ মার্কেট থেকে পিলখানায় বিজিবির সদর দপ্তর প্রাঙ্গণের ভেতর দিয়ে বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল, বংশাল এলাকা দিয়ে বুড়িগঙ্গা, জুরাইন ও শ্যামপুর এলাকায় মাস্টার ড্রেন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব সুন্দর সুন্দর উদ্যোগ কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা হবে, তার কোন সঠিক সময় ও জবাব নেই।
আ. দৈ./ কাশেম