রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫,
১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার

রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
জাতীয়
এলো রে বৈশাখ
বাঁশি তো আগের মতো বাজে না
তানজিকা ইতি
Publish: Monday, 14 April, 2025, 3:10 AM  (ভিজিট : 62)

‘আমি মেলা থেকে তাল পাতার এক বাঁশি কিনে এনেছি, বাঁশি তো আগের মতো বাজে না, মন আমার তেমন যেন সাজে না, তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি’

বলছিলাম আমাদের প্রাণের বৈশাখের বাঁশির কথা। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গানের মতো ছেলেবেলার বৈশাখী ঐতিহ্য যেন আজ বিলুপ্তির পথে।

আছে বৈশাখ, আছে নববর্ষ। হারিয়ে গেছে কামার কুমার, শাঁখারী-বাঁশরী এখন আর বাজেনা বাঁশের বাঁশি, শাখায় সাজেনা হাত, বিলুপ্তপ্রায় তাঁতি সম্প্রদায়ও। হারিয়ে গেছে মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য। বাঁশ- বেঁতের কুলা-ডুলা-নুলা, বিলুপ্তপ্রায় মাটির বাসন কোসন। বাহারি রঙের মাটির পুতুল, কারুখোচিত কলসি, হাড়ি, হাতি, ঘোড়া, গরু এসব আর চোখে পড়েনা। চৈত্রসংক্রান্তি আর পহেলা বৈশাখে মুড়ি, মুড়কি, বাতাসা, মুরালি, তালের পাটালি যেন আকাশে বাতাসে উড়ত। বাউলা বাতাসে ভেসে বেড়াত বাউলের গান। সুনিপুণ কারিগরদের প্রাণের ছোঁয়ায় আবহমান বাংলাকে নিয়ে রেঙে উঠত যে বৈশাখ তা আজ চরিত্র বদলেছে। 

এবারের বৈশাখে নগরেও লেগেছে ব্যান্ড সঙ্গীতের ছোঁয়া, পোশাকে লেগেছে বুটিক হাউজগুলোর নানা ফ্যাশন। গ্রামে গ্রামে পৌঁছে গেছে শহরের কারখানায় তৈরি প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী।

ইট-কাঠ-পাথরের জীবনে যেন হার মেনেছে বাঁশ-বেত-মাটি-কাঁসার সেইসব দৃষ্টিনন্দন মনকাড়া দ্রব্যসামগ্রী। আমাদের দেশের কুমারদের তৈরি কয়েকটি মৃৎশিল্পের নাম হলো মাটির কলস, হাড়ি, সরা, মটকা, বাসন-কোসন, পেয়ালা, সুরাই, ডালা, পিঠে তৈরির ছাঁচ, পুতুল ও নানারকম পশু। এছাড়া আমাদের দেশে একসময় ছিল অনিন্দ্যসুন্দর মৃৎশিল্প টেরাকোটা। নদীর পাড়ে কিংবা কোনো বটগাছের তলায় এখন আর অহরহ চোখে পড়েনা আড়ং বা মেলা। শিশুদের পাতার বাঁশি, রঙিন চশমা, মুখোশ আর চোখে পড়েনা।

মৃৎশিল্প : একসময় গ্রামের পাশের বিভিন্ন জমি থেকে মানুষজন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা গাড়ি মাটি ক্রয় করতে পারতেন। তবে, এখন দেশে বেড়েছে ইটের ভাটা। যার কারণে আর ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা গাড়ি মাটি ক্রয় করতে হচ্ছে। আগে খড়ি কেনা হতো ৯০ থেকে ১০০ টাকা মণ, যা বর্তমানে ২০০ টাকা মণ কিনতে হয়। অথচ মাটির তৈরী তৈজসপত্রের দাম তুলনামূলক বাড়ে নি। একটি ফুলের টব ও দইয়ের পাত্রে দাম বেড়েছে মাত্র ১ থেকে ২ টাকা এবং প্রতিটি পাটের দাম বেড়েছে ৪-৫ টাকা। এ জন্য বেশি দামে মাটি, খড়ি কিনে এসব জিনিসপত্র তৈরি করতে হচ্ছে।

এছাড়া ভাত, তরকারির পাতিল, বড় কলস, মটকিসহ বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি-পাতিল আর বাচ্চাদের খেলনা মিলিয়ে ৪০-৫০ প্রকার জিনিস তৈরি করা হতো। কিন্তু এখন মাত্র ৮-১০ প্রকার জিনিস তৈরি হচ্ছে। কেবল গ্রীষ্মকালে বিভিন্ন প্রকার জিনিস তৈরির চাপ বাড়ে। এ ছাড়া বছরের অন্যান্য (বর্ষাকাল ও শীতকাল) সময়ে কাজের তেমন চাপ থাকে না। তবে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হারিয়ে যাওয়া এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে করেন মৃৎশিল্পীরা।

এক সময় বাসা-বাড়িতে হাড়ি পাতিল থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে ব্যবহারে কদর ছিল মাটির তৈজসপত্র। কিন্তু কালের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় তাদের ভালোবাসার সেই জীবিকার জায়গাটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। দিন যতই যাচ্ছে, ততই বাড়ছে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার। আর প্রযুক্তির ব্যবহারের কারণে মাটির তৈরী তৈজসপত্রের জায়গা দখল করছে প্লাস্টিক ও এ্যালমুনিয়ামের তৈরি সামগ্রী। ফলে এক সময় জৌলুস আর দাপট থাকা এই শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ভালো নেই এই পেশায় থাকা কারিগর ও বিক্রেতারা। যাদেরকে কুমার বা পাল বলা হয়। 

এই পেশা থেকে কোনো রকম আয় করে পরিবারের খরচ চালাচ্ছেন মৃৎশিল্পরা। পালেরা তাদের নিপুন হাতের ছোঁয়ায় তৈরি করে তৈজসপত্র, রয়েছে মাটির তৈরি হাড়ি, সরা, কলস, ফুলের টব, দেবদেবীর মূর্তিসহ আরো অনেক কিছু। এক সময় বাইরেও মাটির তৈজসপত্রের কদর ছিল অনেক। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে এ শিল্প। পরিবর্তে স্থান দখল করেছে স্টেইনলেস স্টিল, প্লাস্টিক, অ্যালমুনিয়ামের তৈরি সরঞ্জাম। তাই স্বচ্ছলতা না থাকায় জীবন-জীবিকার তাগিদে এ শিল্পের আশা ছেড়ে দিচ্ছেন অনেকে। কিন্তু কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় এবং আয় কমে যাওয়াই সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে তারা। তাই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহযোগিতা প্রত্যাশা এখানকার মৃৎশিল্পীদের।তবে নিত্য ব্যবহারের জিনিসপত্রের ব্যবহার কমলেও বেড়েছে পোড়ামাটির গৃহসজ্জার চাহিদা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আবারো হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে এমনটাই মনে করেন মৃতশিল্পীরাতাঁত শিল্প: তাঁত হচ্ছে এক ধরনের যন্ত্র যা দিয়ে তুলা বা তুলা হতে উৎপন্ন সুতা থেকে কাপড় বানানো যায়। তাঁত বিভিন্ন রকমের হতে পারে । খুব ছোট আকারের হাতে বহন যোগ্য তাঁত থেকে শুরু করে বিশাল আকৃতির স্থির তাঁত দেখা যায়। আধুনিক বস্ত্র কারখানা গুলোতে স্বয়ংক্রিয় তাঁত ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

বর্তমানে অনেক তাঁতকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ দিন কাটছে তাদের। অনেকে এখন পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে হয়েছেন রিকশা-ভ্যান চালক। আবার অনেকে বিভিন্ন গার্মেন্টসের কাপড় ক্রয় করে এনে গ্রামগঞ্জে বিক্রি করে বেড়াচ্ছেন। সেই প্রাচীন আমল থেকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্প কাপড় তৈরিতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। শুরু থেকে তাঁতশিল্পের ভূমিকা ছিল নানা রকম শৌখিন, কারুকার্যময় পোশাক তৈরিতে। তবে প্রয়োজনের তাগিদে তাদের প্রান কাজ ছিল নিত্য প্রয়োজনীয় সাধারণের পোশাক বানানোই। দেশীয় তুলা থেকে সুতা উৎপাদন করে তাঁতিরা নিজেরাই কাপড় তৈরি করে নেন। বেশির ভাগ তাঁতি সুতা বাজার থেকে কিনে নেন। প্রয়োজনীয় কাপড়ের মাপ, নকশা নিজেই তৈরি করেন। তাঁতিদের কারিগর বলা হলেও তারা প্রত্যেকেই একেকজন শিল্পী। যদিও আদিকাল থেকেই তাদের অবস্থা দিন আনি দিন খাইয়ের মতোই। 

এক গজ কাপড় তৈরিতে তাদের সারা দিন লাগলেও বর্তমানে তারা দৈনিক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার বেশি মজুরি পান না। বংশ পরম্পরায় এ পেশা চলে আসার কারণে দেশভাগের পর যখন আধুনিক শিল্প-কারখানা তৈরি হতে থাকে, তখন অনেক পরিবারের উত্তর-প্রজন্ম কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। তাদের করুণগাঁথা লেখা আছে বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায়। 

তাঁতের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ পেশার সাথে জড়িত মানুষের জন্য নেই প্রয়োজনীয় পেশাগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা।
কুটিরশিল্প: বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। এ শিল্পে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির প্রতিভাস ফুটে ওঠে, যার নির্মাতা পল্লী অঞ্চলের মানুষ। নিজেদের জীবিকা এবং নিজসত ব্যবহারের জন্য তারা এ সকল পণ্য উৎপাদন করে। বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাপাতা, গাছপালা, নদ-নদী ও আকাশ কুটির শিল্পের ডিজাইনে বা মোটিভে দেখা যায়। কুটির শিল্পকে অনেকে হস্তশিল্প, কারুশিল্প, সৌখিন শিল্পকর্ম, গ্রামীণ শিল্পও বলেন। বর্তমানে শহর এলাকায়ও কুটির শিল্পের প্রসার ঘটছে।

গ্রামীণ জনপদে একসময় বাঁশঝাড় ছিল না, এমনটা কল্পনাও করা যেত না। যেখানে গ্রাম সেখানেই বাঁশঝাড়- এমনটাই ছিল স্বাভাবিক। বাড়ির পাশে বাঁশঝাড়-বেত বনের ঐতিহ্য গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ; কিন্তু বর্তমানে জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এই বাঁশ ও বেত শিল্প। গ্রামীণ জনপদে বাংলার ঘরে ঘরে তৈরি হতো বাঁশ ও বেতের হাজারো পণ্যসামগ্রী। ঘরের কাছের ঝাড় থেকে তরতাজা বাঁশ কেটে গৃহিণীরা তৈরি করতেন হরেক রকম জিনিস। অনেকে এটিকে পেশা হিসেবে জীবনজীবিকা নির্বাহ করতেন। দরিদ্র পরিবারের অনেকের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন ছিল এগুলো; কিন্তু আজ কটি গ্রামে এ হস্তশিল্প উপার্জনের পেশা হিসেবে বেঁচে আছে তা ভাবনার বিষয়। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই বাপ-দাদার আমলের পেশা ত্যাগ করে অন্য পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন বা হচ্ছে আবার যদিও কোনোভাবে ম্যানেজ করে আসবাবপত্র তৈরি করি তার প্রকৃত মূল্য বাজারে কেউ দেবে না, তাই ওই পেশা আর ধরে রাখা সম্ভব নয়।

চেয়ার, টেবিল, বইয়ের সেল্ফ, মোড়া, কুলা, ঝুড়ি, ডোল, চাটাই থেকে শুরু করে এমনকি ড্রইং রুমের আসবাবপত্র তৈরিতেও বাঁশ ও বেত প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হতো। এ ছাড়া মাছ ধরার পলো, হাঁস, মুরগির খাঁচা, শিশুদের ঘুম পাড়ানোর দোলনা এখনো গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। এখন সচরাচর গ্রামীণ উৎসব বা মেলায়ও বাঁশ-বেত জাত শিল্পীদের তৈরি উন্নতমানের খোল, চাটাই, খালুই, ধামা, দোয়াড়, আড়ি, টোনা, আড়, হাপটা, মোড়া, বুকসেলফ চোখে পড়ে খুব কম।

কুটির শিল্প টিকিয়ে রাখতে যা যা করণীয় এবং বর্তমান সরকার সেদিকে খেয়াল রেখে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
বৈশাখ আসে, বৈশাখ যায়। কামার-কুমার, তাঁতি, শাঁখারি, বাঁশরি হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তি ঘটছে বাঙালি শিল্পের, হারিয়ে যাচ্ছে পুরোনো ঐতিহ্য। তা আর ফিরে পাবো কি? এখনো যতটুকুই আছে, প্রয়োজন সংরক্ষণ। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন এখনো সময় আছে পুনরুদ্ধারের।

আ.দৈ/আরএস


   বিষয়:  বাঁশি   তো   আগের   মতো   বাজে   না  
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

নারী নির্যাতন বন্ধে আইনের সংশোধন প্রয়োজন: মামুনুল হক
৬২ জন পুলিশ সদস্য পাচ্ছেন বিপিএম ও পিপিএম পদক
ভারত-পাকিস্তান সংকট নিরসনের চেষ্টা করছে সৌদি আরব
পাঁচ বছর আগে অপহরণ হওয়া স্কুলছাত্র নিজেই ফিরল বাসায়
রাজনীতির চেয়ারে ঘুণপোকা ধরেছে, এটি সংস্কার করা প্রয়োজন: ব্যারিস্টার ফুয়াদ
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ডিএনসিসিতে বর্জ্যব্যবস্থাপানা বিভাগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের অভিযান
কাশ্মীরে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও প্রকাশ
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী দলের সভা
পদত্যাগ করলেন আটাবের সবুজ মুন্সী
ঢাকা দুই সিটিতে আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিএনপির ব্যাপক তদবির
জাতীয়- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝