এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে ’ই-ট্রেড লাইসেন্স’ ইস্যু করা হয়েছে। বাংলাদেশে কাঁকড়ার ব্যবসা করার জন্য গত গত ৯ মার্চ আবেদন এবং ১১ মার্চ বিকেলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে ই-ট্রেড লাইসেন্সটি ইস্যু করা হয়। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ট্রাম্প এসোসিয়েশন’। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প, বাবার নাম ফ্রেড ট্রাম্প, মায়ের নাম ম্যারি অ্যান ম্যাকলিওড ট্রাম্প।মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মা-বাবার নামও তাই। আরো বিস্ময়কর বিষয় হলো,’ই-ট্রেড লাইসেন্সে’মালিক হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি রয়েছে।
এদিকে ডিএনসিসির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ তার ফেসবুক পেইজে ‘উল্লেখ করেছেন, ‘ ট্রাম্পের নামে কোন লাইসেন্স ইস্যু করা হয় নাই। আলোচ্য লাইসেন্সটি ড্রাফট কপি। অনলাইনে এটির অস্তিত্ব নেই।’
লাইসেন্সে মালিকের ব্যক্তিগত তথ্য ও ঠিকানা,সবই দেওয়া হয়েছে, স্থায়ী ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ১২৫তম সড়কের ৫৫ (পশ্চিম)। এরপরও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার আফতাব নগরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে ’ই-ট্রেড লাইসেন্স’ হয়েছে।
গত ১৩ মার্চ ‘আজকের দৈনিক’ পত্রিকায় ‘ট্রেড লাইসেন্সে’ অতিমাত্রায় ডিজিটালের নামে সরকারের আইনকে ওপনে চ্যালেঞ্জ ডিএনসিসির এবং স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার মুখোমুখি হচ্ছেন ডিএনসিসির প্রশাসক শিরোনামে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।ওই প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়েছে, এই সুযোগে গত ৯ মার্চ ডিএনসিসিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্পের নামে, তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ট্রাম্প অ্যাসোসিয়েশন, ঠিকানা সাতারকুল, ডিএনসিসি ঢাকা এবং গত ৯ মার্চ আরেক মার্কিন ব্যবসায়ি ‘ ইলন মাক্স’ এর নামে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান টুইটার, ঠিকানা ভাটারা ঢাকা ঠিকানায়। অনলাইনে আবেদন দায়ের করা হয়েছে। এই দুইটি আবেদন ডিএনসিসির ওয়েভ সাইটে ড্রাফট হিসেবে আছে বলেন জানান ডিএনসিসির কর্মকর্তারা।
ডিএনসিসির সূত্র মতে, ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান, উপ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন এবং কয়েকজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা অতিউৎসাহী হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে (অটোমেটেড) ‘ই-ট্রেড লাইসেন্স’ ইস্যুর বিষয়টি চালু করতে গিয়ে রাজস্ব বিভাগের ১২টা বাজিয়েছেন। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মূল্যবান সনদ হিসেবে ব্যবহ্নত হয় ‘ট্রেড লাইসেন্স’।
এই ‘ট্রেড লাইসেন্স’ ছাড়া ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না। সেখানে কি ভাবে ডিএনসিসিতে যাচাই- বাছাই ছাড়াই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের মালিক, নাম, ঠিকানা ও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ‘ই-ট্রেড লাইসেন্স’ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে এখন বকেয়া ফি না দিয়ে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লাইসেন্স করে নিচ্ছেন। অনেকে আবার কম ফি দিয়ে প্রকৃত ব্যবসাকে আড়াল করে অন্য ধরনের ব্যবসার লাইসেন্স নিচ্ছেন।এ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্সের সঙ্গে সাইনবোর্ড কর হিসেবে সাইনবোর্ডের আকার অনুযায়ী যে ফি পরিশোধ করার কথা, সেটা অনেকে করছেন না। আবেদনে অনেকে সর্বনিম্ন সাইনবোর্ডের আকার দেখিয়ে সেই টাকা জমা দিচ্ছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামে ভুয়া ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন ডিএনসিসির রাজস্ব বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘ই-ট্রেড লাইসেন্স’ আবেদনকারী নির্ধারিত সব ফি ২ হাজার ২৬৫ টাকা ডিএনসিসির অনুকূলে পরিশোধ করেই ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদে। নিয়ম অনুসারে, মেয়াদকালের মধ্যে তিনি চাইলে এই লাইসেন্স প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারবেন।
ডিএনসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, লাইসেন্সের আবেদনের সঙ্গে আবেদনকারী দুটি নথি যুক্ত করেছেন। একটি অফিস ভাড়ার চুক্তিপত্র, অন্যটি একজন চীনা নাগরিকের বাংলাদেশের ভিসা। লাইসেন্সটি দেওয়া হয়েছে ডিএনসিসির অঞ্চল-১০-এর সাতারকুল এলাকা থেকে। ব্যবসার প্রকৃতি: অন্যান্য-একক। ব্যবসার ধরন: কাঁকড়া মাছ বিক্রেতা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ঠিকানা: ডিএনসিসির আওতাধীন বাড্ডার আফতাবনগরের ২ নম্বর সেক্টরের এফ ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ৪০/৪২ নম্বর বাড়ি। অথচ এই ছিকানায় কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। তার স্থায়ী ঠিকানা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের ১২৫তম সড়কের ৫৫ (পশ্চিম)।
সূত্র মতে, ‘ই-ট্রেড লাইসেন্সের’ আরেক আবেদনে একটি অফিস ভাড়ার চুক্তিপত্রে দেখা যায়, রাজধানীর তেজগাঁওয়ের মণিপুরিপাড়া এলাকার ১০৬/১৯ নম্বর বাড়ি। এই চুক্তিপত্রে ব্যবসার ধরন লেখা ঠিকাদারি। মাসিক ভাড়া ৮ হাজার টাকা। চুক্তির মেয়াদ আগামী বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত। আবেদনকারী এক চীনা নাগরিকের বাংলাদেশের ভিসার একটি নথি যুক্ত করা হয়েছে।তার নাম কাংজুয়াং ডিং,ভিসার মেয়াদ আগামী ২২ মে পর্যন্ত।
উল্লেখ্য,দেশের বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের সোনালী ব্যাংক ঋণ জালিয়াতি ও কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের সুনিদিষ্ট অভিযোগে দুদক একাধিক মামলা দায়ের করে।ওই মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান,ব্যবস্থাপনা পরিচালক,ব্যাংক কর্মকর্তার সাথে সাভারের তেতুজড়া ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকারকে আসামি হিসেবে যুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে দুদক। কারণ হলমার্ক গ্রুপের মালিকরা ইউপি চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছিলেন এবং ব্যাংক হিসাব খোলতে ওই ট্রেড লাইন্সে ব্যবহার করা হয়। এই ঘটনায় দুদকের মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার আসামি হয়েছেন এবং বিচারিক আদালত তাকেও কারাদন্ড দিয়েছেন।
ডিএনসিসির ট্রেড লাইসেন্স সংক্রান্ত বিষয়ে আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাসহ রাজস্ব বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকেরই এবার প্রতারক চক্রের অপকর্মের খেসারতের মামলায় আসামি হবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, আসামি হবার পর পালিয়েও শেষ রক্ষা হবে না।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএনসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান,ডিএনসিসিতে সাবেক মেয়র মো.আতিকুল ইসলামের রেখে যাওয়া সিন্ডিকেটের প্রভাবশালী সদস্য প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো.মনিরুজ্জাম,ভারপ্রাপ্ত সচিব মামুন উল হাসান, উপ প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন এবং কয়েকজন আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা পরিকল্পিতভাবে বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে বিপদে ফেলতেই এই আত্মঘাতিমূলক অপকর্মটি চালু করেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আইন, সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন এবং ডিএনসিসি বোর্ড মিটিংয়ের রেজুলেশন ছাড়া কি ভাবে এই বেআইনী অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে।এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
এই সুযোগে ডিএনসিসিতে আবাসিক,বাণিজ্যিক ও শিল্পাঞ্চলে গণহারে ওইসব এলাকায় কম্পিউটার দোকানে বসেই ভুয়া ঠিকানা এবং ব্যবসার ধরন লিখে আবেদন করার পর দ্রুত ফি প্রদান করে ‘ট্রেড লাইসেন্স’ কপি কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করে নেয়ার হিরিক পড়েছে। আর এই সুযোগে ওইসব কম্পিউটারেই ট্রেডলাইসেন্সের ভুল ত্রুটি সংশোধান ও ঠিকানা পরিবর্তন করতে পারছেন।
এদিকে ডিএনসিসির প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে স্বীকার করেছেন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে লাইসেন্স করার সুযোগে ভুয়া ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই ‘ই-ট্রেড লাইসেন্স’ ইস্যু হচ্ছে। ট্রাম্পের নামে ইস্যু হওয়া ই-ট্রেড লাইসেন্সটি সেই ঘটনারই একটি উদাহরণ। মনিরুজ্জামান আরো স্বীকার করেছেন, হোটেল- রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহৃত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে আবেদনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুর সিদ্ধান্ত হয় গত ৯ মার্চ।
আ, দৈ./ কাশেম