সম্প্রতি সময় ভুমিকম্পের প্রবণা বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনভার ভুমিকম্পের কেপে উঠেছে। এতে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিশেষজ্ঞরা বড় ধরনের ভুমিকম্পের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন ভৌগলিক কারধে দেশ ভুমিকম্প ঝুকিতে রয়েছে। আবহাওয় অফিস সুত্রে জানা গেছে গত ১০ দিনে চার দফা ছোট থেকে মাঝারি আকারের যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, প্রায় প্রতিটিরই উৎপত্তিস্থল ছিল দেশের সীমানার ভেতর বা আশপাশে।
গত বুধবারও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা কেঁপে উঠে ভূমিকম্পে। বেলা ১১টা ৩৬ মিনিটে এ ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৫.৬। ভূমিকম্পে তাৎক্ষনিকভাবে কোনো ক্ষতির তথ্য মেলেনি। যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের ইয়ারিপক এলাকা। ভূমিকম্পটির গভীরতা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১০ কিলোমিটার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগে দেশের স্থান এবং দেরেশর ভেতরে অসংখ্য সাইসুিমক গ্যাপ রয়েছে যেগুলো ভুমিকম্পের ঝুকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়া দেশের বাইরে ভারতের মেঘালয়, মনিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমারও ব্যাপক ভুমিকম্প প্রবলন । এছাড়া সূদুর নেপাল থেকেও উৎপত্তি হওয়ায় ভুমিকম্প দেশের অধিকাংশ এলাকা কেপে উঠেছে। ফলে দেশের চারদিকে এওক ধরনের ভুািমকম্প বলয় তৈরি হয়েছে। যা ঝুকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
দেশের ভেতরে ঘন ঘন মৃদু ভুকিম্প সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সম্প্রতি কয়েক বছরের মৃদু ভুকিম্পের পরিমাণ বেড়েছে। তারা বলেন, আঞ্চলিক টেকটোনিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে দুটি প্লেটের কারণে চূতি রেখাগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। যমুনা, মেঘনা অববাহিকার চ্যুতি রেখাগুলো এখন সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে।ঘন ঘন মৃদু ভুমিকম্প বড় ধরণের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও দেশে বড় ধরণের ভুমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে দেশের অভ্যন্তরে যে চারটি চ্যুতি রেখা বিদ্যমান রয়েছে সেগুলো এখন অধিক সক্রিয়। যে কোন সময় এখান থেকে বড় মাত্রার ভুমিকম্প হতে পারে। তবে ঘন ঘন মৃদু ভুমিকম্প হলে চ্যুতি রেখা থেকে শক্তি বেরিয়ে এসে তা দুর্বল হয়ে পড়ে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিশ্বে দুটি ভুমিকম্প বলয়ে বিভক্ত। এ দুটি বলয়ের মধ্যে রয়েছে আলপাইন হিমালয় আন্দামান-সুমাত্রা ভুমিকম্প বলয়। এ বলয়ের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বে যত ভুমিকম্প সৃষ্টি হয় তার শতকরা ৭ ভাগ হয় এ বলয়ের মধ্যে। অপরটি রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশ সমুহের ভুমিকম্প বলয়। এ বলয়ে প্রায় ৯০ ভাগ ভুমিকম্প হয়ে থাকে। জাপান এ ভুমিকম্প বলয়ের মধ্যে অবস্থিত। ফলে জাপানে প্রায় প্রতিদিনই মৃদু ভুমিকম্প অনুভুত হয়ে থাকে। বিশেজ্ঞরা বলছেন বাংলাদেশ যে বলয়ে অবস্থিত তুলনামুলক ভাবে এ বলয়ে ভুকিম্পে পরিমাণ অনেক কম। এ বলয়ে যে সব দেশ রয়েছে সব দেশই একই ধরণের ভুমিকম্প ঝুকিতে রয়েছে। এরপরও বাংলাদেশ অধিক ঝুকিপূর্ণ ধরা হচ্ছে। এর কারণ দেশটিতে জনসংখ্যার হার অধিক। ভাটির দেশ হওয়া শিলার গঠন দুর্বল। এছাড়া ঢাকা শহরে রয়েছে দুর্বল অবকাঠামো। জনগণের মধ্যে সচেতনতাও তেমন নেই। আবার ভুমিকম্প ঝুকি মোকাবেলায় সরকারের মধ্যে বড় ধরণে প্রস্তুতির অভাব রয়েছে। তাঁদের মতে এ চারটি কারণে মুলত বাংলাদেশ বেশি ঝুকিপূর্ণ ভাবা হচ্ছে।
তাদের মতে, ভুমিকম্প একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম আভাস দেয়া এখানো সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে এখানো ব্যাপক গবেষণা চলছে। তবে ভুমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি অনেক মোকাবেলা করা সম্ভব যদি জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়। এ ব্যাপারে সরকার, এনজিও ও গণমাধ্যম কার্যকর ভুমিকা পালন করতে পারে। তাদের মতে তিন ধরণের প্রস্তুতির মাধ্যমে ভুমিকম্প অনেকটা মোকাবেলা করা সম্ভব। এর মধ্যে ভুমিকম্প মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি থাকবে হবে। ভুমিকম্পকালী করনীয় ঠিক করা এবং পরবর্তী প্রস্তুতি ও করনীয় ঠিক করা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ছোট ও মাঝারি ভূকম্পনে বড় শক্তি বের হওয়ার একটা প্রবণতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার মানে, যে কোনো সময় একটি বড় ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলো ফেরত আসার একটি সময় হয়ে গেছে। তবে এই বড় ভূমিকম্প কবে হবে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। গত বছর হওয়া ‘আরবান রেজিলিয়েন্স প্রজেক্ট : রাজউক অংশ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৪০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, বাংলাদেশ ভূকম্পনের সক্রিয় এলাকায় অবস্থিত। দুর্যোগ সূচক অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ভূমিকম্পের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি শহরের মধ্যে রয়েছে ঢাকা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোটখাটো কম্পন দেশের আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা নির্দেশ করে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্মিজ প্লেট ও ইন্ডিয়ান প্লেটের পরস্পরমুখী গতির কারণেই ঘন ঘন এ ধরনের ভূমিকম্প হচ্ছে। এ দুটি প্লেটের সংযোগস্থলে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমে রয়েছে, যেগুলো বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে। আগে হোক বা পরে, এই শক্তি বেরিয়ে আসবেই। ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া একটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির লক্ষণ। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে সিলেটসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ভূমিকম্পের সময়ে কী করতে হবে, তার মহড়া দেওয়া শুরু করতে হবে। ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি ও মহড়াকে নিয়মিত চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
আ.দৈ/আরএস