বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বড় বড় মেগা প্রকল্পকে ঘিরে প্রতি বছরই স্ফীত হয়েছে বাজেটের আকার। যদিও এর সঙ্গে সংগতি রেখে রাজস্ব আহরণ বাড়েনি। বরং গোষ্ঠীস্বার্থে করছাড়সহ নানা সুবিধা দেয়ায় রাজস্ব হারাতে হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার পর পরই জুলাই আন্দোলন তথা ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। অর্থনীতিতেও এ পরিবর্তনের হাওয়া দৃশ্যমান।
তবে এতোকিছুর পরেও অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) বাজেট বাস্তবায়নের গতি বেড়েছে। আলোচিত সময়ে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। পাঁচ মাসে সার্বিকভাবে বাজেট বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে মোট বরাদ্দের ২৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আগের অর্থবছরের (২০২৩-২৪) একই সময়ে বাজেট বাস্তবায়ন হার ছিল ২০ দশমিক ৭৩।
এর আগের অর্থবছরের(২০২২-২৩) প্রথম পাঁচ মাসে ছিল ২২ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ প্রকাশিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় গত অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই টাকা খরচের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ওপর কয়েকটি বিধিনিষেধ দেয়া হয়। তা শেষ না হতেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলে উভয় ধাক্কার নেতিবাচক প্রভাবে বাজেট বাস্তবায়ন (প্রথম প্রান্তিকে) হার গত তিন বাজেটের একই সময়ের তুলনায় কমে যায়।
চলতি অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট দেয় বিগত আওমায়ী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও সেই বাজেট অব্যাহত রয়েছে। বাজেটের বড় দুটি অংশ হচ্ছে উন্নয়ন বাজেট এবং অনুন্নয়ন বা পরিচালন বাজেট। অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে পরিচালন বা অনুন্নয়ন খাতে বাজেট বাস্তবায়নের হার ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ। টাকার অঙ্কে যা ১ লাখ ৭০ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয় ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। তবে এ সময়ে উন্নয়ন ব্যয় কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশে। টাকার অঙ্কে যা ২৪ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ৩৩ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। চলতি বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রোধে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে সরকারি ব্যয়েও সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এরসঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কাটছাঁট হচ্ছে। অর্থবছরের শুরু থেকে আন্দোলন ও পরে আগস্টে ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি প্রশাসনে রদবদলের ধাক্কায় সরকারি উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে সরকারি ব্যয়ে সাশ্রয়ী পদক্ষেপ থাকলেও গত সরকারের নেয়া অনিয়ন্ত্রিত ঋণের সুদ পরিশোধ ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। তা ছাড়া পরিচালন বাজেটে কাটছাঁটের খুব একটা সুযোগ থাকে না। আবার অনাকাঙ্খিত কিছু ব্যয় বাড়ায় পরিচালন বাজেটে ব্যয় কমানো সম্ভব হয়নি। তাই সার্বিক বাজেট বাস্তবায়ন কিছুটা বেড়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণে বাজেট বাস্তবায়নে বিগত সরকারের বিদেশি দাতাগোষ্ঠীর অর্থের ওপর নির্ভরতা বেড়েছ। উন্নয়নের নামে এখানে অনেক অপ্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করা হয়েছে। সে খরচকে সামনে রেখে দুর্নীতি, লুটপাট ও নানা রকম অনিয়ম হয়েছে। এজন্য ঋণভিত্তিক প্রকল্পের ওপর নির্ভরতাও অতিমাত্রায় বেড়েছে। এক্ষেত্রে পুরো বাজেট প্রক্রিয়াটিই হয়েছে অস্বচ্ছ ও দুর্নীতিনির্ভর ব্যবস্থার মাধ্যমে। উন্নয়নের দিকে অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে পরিচালনার দরকার ছিল এবং এর যেসব সংস্কার করার প্রয়োজন ছিল, সেগুলো করা হয়নি। কারণ এসব সংস্কার বেশ কঠিন। গোষ্ঠীতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদসহ অনেককেই অখুশি করবে।
তিনি আরো বলেন, সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থবছরের মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় পার হয়েছিল। বাজেটকে পুনর্বিবেচনার বড় ধরনের সুযোগ ছিল। বর্তমান বাজেটটি আগের সরকার অবাস্তব কিছু লক্ষ্যমাত্রা ও পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার সেটিকে তেমন একটা পরিবর্তন না করে বরং আগের কাঠামোর মধ্যেই রেখে দিয়েছে। এ বাজেটকে কেন্দ্র করে জড়িত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যেত। সুযোগ ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোরও। পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বাজেটকে পুনর্বিবেচনা করা যেত। সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশাও ছিল। যদিও আমার কাছে মনে হয়েছে অনেকটা সেই পুরেনো পথেই হাঁটা হয়েছে, খুব বেশি গুণগত পরিবর্তন দেখা যায়নি।
সুদ পরিশোধেই সরকারি ব্যয়ের ৩৬ শতাংশ
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাজেটের একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ব্যয়ের খাত দাঁড়িয়েছে সুদ পরিশোধ। অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সরকারি ব্যয়ের ৩৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ অর্থাৎ ৭১ হাজার ২১৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৬৩ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ৭ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৪০ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা।
সুদ পরিশোধের এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে শুধু সুদ পরিশোধেই প্রয়োজন হবে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে সরকারের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় বাড়ে ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ এবং প্রথমবারের মতো ঋণের সুদ পরিশোধ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়; যা সরকারের মোট ব্যয়ের ২৮ শতাংশ।
পাঁচ মাসে পরিচালন বাজেটের আওতায় অন্যতম বড় খরচের খাত হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। এ খাতে ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ২৫ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন বাবদ ব্যয় হয়েছে ৯ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। এদিকে পাঁচ মাসে জ্বালানি, সারসহ বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি বাবদ ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা।
একই সময়ে পরিচালন বাজেটের আওতায় অন্য খাতগুলোর মধ্যে পাবলিক অর্ডার ও সেফটি খাতে ৩০ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা, শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৯ হাজার ৩৩৫ কোটি, প্রতিরক্ষা ১০ হাজার ৫৩৮ কোটি, কৃষিতে ১২ হাজার ৭৫৩ কোটি, স্বাস্থ্যে ৪ হাজার ৯৪৬ কোটি এবং স্থানীয় সরকার খাতে ১ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।