সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট সরকারের সহযোগি,নানা অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ফ্রিস্টাইলে ভুয়া বিল ভাউচারে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং আত্মসাতের মুলহোতা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র মো. আতিকুল ইসলামসহ ডজন খানিক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ধরতে মাঠে নেমেছে দুদক। ডিএনসিসিতে হাজার কোটি টাকা লোপাটের রেকর্ডপত্র দুদকের হাতে। আতিকের রেখে যাওয়া দুর্নীতিবাজরা এখনো বহাল তবিয়তে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুদকের উপ পরিচালক মো. আলমগীর হোসেনের স্বাক্ষরে গত ২২ জানুয়ারি ডিএনসিসির প্রশাসকের দপ্তওে সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট রেকর্ড পত্র ১০ দিনের মধ্যে সরবরাহের জন্য চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠি পাবার পর ডিএনসিসির পক্ষ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় চেয়ে আবেদন জানানো হয়। পরে ফেব্রুয়ারি মাসের শেস সপ্তাহে ডিএনসিসির পক্ষ থেকে দুদকের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে কয়েকশত পৃষ্টার কিছুর রেকর্ডপত্রের ফটোকপি দাখিলের খবর পাওয়া গেছে। এই বিষয়টি ডিএনসিসির পক্ষ থেকে একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে ডিএনসিসির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের সহযোগি,চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ ও শত শত কোটি টাকা লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে কিনা জানতে চাইলে,বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ “ আজকের দৈনিককে” জবাবে বলেন, সঠিক তথ্য পেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আপনারা তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন। ডিএনসিসিতে দুর্নীতিবাজদের ঠাই নেই।
সূত্রমতে, দুদকের পাঠানো চিঠিতে, ১, সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের আমলে ২০২১ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর ঠিকানা রিসোর্টের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কিত মতবিনিময় সভার বিল- ভাউচার সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি চাওয়া হয়েছে। আরো চাওয়া হয়েছে; ২, মেয়র আতিকুল ইসলাম পদ্মাসেতু উদ্বোধনের দিন ডিএনসিসিতে বিভিন্ন সড়কে আলোকসজ্জা করণের খরচের অনুমোদন, কার্যাদেশ, কার্য সম্পাদন, বিল-ভাউচারের সত্যায়িত ফটো কপি।
৩, আতিকুল ইসলামে মেয়র থাকাকালে মেট্রোরেল উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের খরচের অনুমোদন,বরাদ্দ, বিল-ভাউচারের সত্যায়িত ফটো কপি।
৪,ডিএনসিসির ‘কর্পোরেশনের বোর্ড সভার নামে মুন্সীগঞ্জে মাওয়া রিসোর্টে সভার নামে উত্তোলিত বিলের বরাদ্দ,ব্যয়ের পদ্দতি এবং এ সংক্রান্ত বিল-ভাউচারের সত্যায়িত ফটো কপি এবং আলোচিত ব্যয় সংক্রান্ত নীতিমালার পক্ষে প্রমাণাদিও চাওয়া হয়েছে।
৫, মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে বুশরাকে ‘হিট অফিসার নিয়োগের নীতিমালসহ নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র,প্রদত্ত বেতনের স্টেটমেন্ট (অর্থ বছরভিত্তিক) হিট অফিসার বুশরার কার্যালে ঢাকা শহরে গরমকালে পানি ছিটানোর পরিমান,অর্থের বরাদ্দ এবং ব্যয় ভাউচারসহ রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত কপি।
৬, মেয়র আতিকুল ইসলামের বড় ভাই সাবেক বিচারপতি মো. তোফাজ্জাল ইসলামের ছেলে ইমরানকে মেয়রের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের নীতিমালা, নিয়োগ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র,প্রদত্ত বেতনের স্টেটমেন্টসহ সত্যায়িত ফটোকপি।
৭, ডিএনসিসির নগর ভবনের ৬ষ্ঠতলায় দেওয়াল ও অফিস সাজানো, গুলশান-২ এ ট্রাফিক সিগন্যালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এধাই) স্থাপনের বরাদ্দ, ব্যয়ের পদ্ধতি এবং কত টাকা ব্যয় করা হয়েছে, এ সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি।
৮, মেয়র থাকাকালে নগর ভবনের সামনে ছিন্নমুল মানুষের ইফতার ও পেন্ডেলের বরাদ্দ কত টাকা ছিল, কি ভাবে বিল পরিশোধ করা হয়েছে, তার সত্যায়িত রেকর্ডপত্র।
৯, মেয়র থাকালে আতিকুল ইসলাশের প্রাপ্প ভাতাদি,অর্থ বছর ভিত্তিক স্টেটমেন্টের সত্যায়িত ফটোকপি। ১০, আতিকুল ইসলামের মেয়রের কার্যকালে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থ বছর পর্যন্ত ডিএনসিসির উন্নয়নমূলক কাজের তালিকা সংক্রান্ত তথ্য চাওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, বর্তমানে আতিকুল ইসলাম কারাগারে বন্দি, তার অন্যতম সহযোগি সাবেক সচিব মাসুদ আলম সিদ্দিক ওএসডি এবং সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা অবসরে গেছেন। তবে তাদের রেখে যাওয়া প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা এখনো ডিএনসিসিতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, আতিকুল ইসলাম মেয়র থাকাকালে লাগামহীনভাবে হাজার হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প,নানা অনুষ্ঠান এবং কেনা কাটার নামে লোপাটের রাম রাজত্ব কায়েম করে ছিলেন। তার এই লোপাটে সহযোগতায় ছিলেন, তার পিএস ফরিদ, মোজাহিদ, এপিএস মোরশেদ, ভাগ্নে তৌফিক, ভাতিজা ইমরান হোসেন, বর্জ্যব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আমিন বাজার ল্যান্ড ফিন্ড প্রকল্পের পরিচালক এস এম শফিকুর রহমান, প্রধান সমাজ কল্যাণ কর্মকর্তা, বড় বড় উন্নয়ন ও সেবা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালকগণ, প্রধান ক্রয় ও ভান্ডার কর্মকর্তা, ক্রয় কর্মকর্তা, একাধিক অঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, মার্কেট শাখার একাধিক কর্মকর্তাসহ ডজন খানিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা। দুদকে তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যারফলে দুদক চিঠি পাঠিয়ে ডিএনসিসি থেকে রেকর্ডপত্র সংগ্রহণ করছে।
উল্লেখ্য,গত ৫ আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সপরিবারে ভারতে পালিয়ে যাবার আগের দিন ৪ আগস্ট পালায় ডিএনসিসির মেয়র আতিক। তবে সপ্তাহ খানিক পরে কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে সাথে নিয়ে সন্ধায় গোপনে নগরভবনে ঢুকার পর কর্মচারীদের ধাওয়ায় কিছু নথিপত্রে পেছনের তারিখে স্বাক্ষর করে দ্রুত পালিয়ে যায় আতিকুল ইসলাম।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে বিস্কুট ক্রয়ের ভুয়া ভাউচার তৈরি পূর্বক ক্রয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ২২ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়েছে দুদক। অভিযানকালে দুদক টিম সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেন।
রেকর্ডপত্রের প্রাথমিক পর্যালোচনায়, সাবেক মেয়রের একান্ত সচিবের বিদায় অনুষ্ঠানে ইমপ্রেস্ট মানি ফান্ড থেকে ১ লাখ টাকা ব্যয়, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে অত্যধিক মূল্যে ৩ হাজার ৬০০ টাকা কেজির বিস্কুট ক্রয় এবং ৩হাজার ১৫০ টাকা কেজির কাজুবাদাম ক্রয় সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। এ ধরনের আরো অনেক অনেক লোপাটের তথ্য রয়েছে।
আরো অভিযোগ রয়েছে, আতিকুল ইসলামের সিন্ডিকেটের অন্যতম সহযোগী আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ডের তত্তাবধায়ক এস এম শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে এখনো শাস্তিমূলক বিভাগীয় কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শুধুমাত্র তাকে নগর পরিকল্পনা বিভাগে স্থপতি পদে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ডের উন্নয়নের নামে ভুয়া বিল ভাউচারে কয়েক কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠেছে। একইসাথে ল্যান্ডফিল্ডের জন্য নতুন জমি অধিগ্রহণের নামেও নানা অনিয়মের অভিযোগ বেশ আলোচনায় রয়েছে।
শুধুতাই নয়, আমিনবাজার ল্যান্ডফিল্ডে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে মাটি ভরাটসহ এই প্রকল্পের জামি ক্রমে/ অধিগ্রহণেও দুর্নীতির আলোচনায় আছে। বিদেশ থেকে অনেক কোটি কোটি টাকা খরচ করে দামী ও মূল্যবান যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও রোড সুইপাড় ক্রয় করা হয়েছে। ওইসব গাড়ি, যন্ত্রপাতি রোড সুইপাড় রক্ষণা বেক্ষনের নামেও বড় ধরনের দুর্নীতি ও লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। কারণ ওই যন্ত্রপাতি, গাড়ি ও রোডসুইপাড় ক্রয়ের কিছু দিন পরই আবার মেরামতের অজুহাতে মাসের পর মাস ওয়ার্কশপে ফেলে রাখা হয় এবং মেরামতের পরও ব্যবহার কারা হয় না এমন অভিযোগ উঠেছে। ডিএনসিসির রেজিষ্ট্রার এবং ওয়ার্কশপের রেকর্ডপত্র ও বিল- ভাউচার যাচাই করলেই দুর্নীতির বিষয়টি বেরিয়ে আসবে বলে জানান সাধারণ কর্মচারীরা।
আ. দৈ./ কাশেম