২০১৮ সালে রাজধানীসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিতগত করে রাখার জন্য পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সহযোগিতায় জাতীয় নির্বাচনী কাজে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করিয়েছেন। ওই নির্বাচন নিয়ে দেশে -বিদেশে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হয়।
অবশেষে গত জুলাই- আগস্ট ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের মুখে গত ৫ আগষ্ট ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রঅ শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে পালিয়ে ভারতের দিল্লীতে আশ্রয় নিয়েছে। এরপর শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক মন্ত্রী,এমপি, নেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা ও সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত কর্মকতাদের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে আইনী পদক্ষে নিচ্ছেন বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার, জাল-জালিয়াতি ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে দিনের ভোট রাতে করার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য পাঁচ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ বিষয়ে বিভিন্ন ভিডিও, দেশি–বিদেশি গণমাধ্যমের প্রচারিত সংবাদ, নির্বাচনের ফলাফল তালিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম সম্পন্ন করে অনুসন্ধান টিম প্রতিবেদন দাখিল করবে।
বুধবার (২২ জানুয়ারি) দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) আক্তার হোসেন গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, ২০১৮ সালের ওই নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন, পুলিশ, র্যাবসহ জড়িত সবার বিরুদ্ধেই অনুসন্ধান করা হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে দুদকে একটি অভিযোগ এসেছে। অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আক্তার হোসেন বলেন, ভোটগ্রহণের আগেরদিন রাতেই ভোট কাস্ট কওে বাক্স ভরে ফেলা হয়। ওই নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করা হবে। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিভিন্ন অনিয়ম, যেমন দিনের ভোট রাতে করা, ব্যালট জালিয়াতি, কিছু কিছু কেন্দ্রে ৯০ শতাংশের বেশি ভোট দেখানো, ব্যাপক আর্থিক লেনদেন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রার্থীকে জেতানো বিষয়ে দুদকে কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে।
অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে প্রতিটি মহানগর, জেলা, বিভাগীয়, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সব নেতা–কর্মী নিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, যেমন পুলিশের আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, র্যাবের প্রধান বেনজীর আহমেদ, পুলিশের সাবেক আইজিপি শহীদুল হক, প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা রিটানিং কর্মকর্তা, বিভাগীয় কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ সুপার, থানার অফিসার ইনচার্জ, জেলা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তার যোগসাজশের কথা উল্লেখ রয়েছে।
তিনি জানান, দুদকের অনুসন্ধানকারী ৫ সদস্যের একটি দল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৭টি আসনে জয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিএনপি ও তাদের মিত্ররা মাত্র সাতটি আসনে জয়ী হয়।
নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে গুরুতর অভিযোগ ওঠে। বিরোধীরা এই নির্বাচনকে ‘নিশি রাতের নির্বাচন’ বলে আখ্যায়িত করে। অভিযোগ করা হয়, নির্বাচনের আগের রাতে বেশিরভাগ ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। এছাড়া নির্বাচনের সাথে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ‘যোগসাজশের’ অভিযোগও দুদকের হাতে জমা পড়েছে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার জন্য দুদক গঠিত দলটি বিভিন্ন ভিডিও, দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং নির্বাচনের ফলাফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। কমিশনের সদস্য মাহবুব তালুকদার বিদায়বেলায় এক সাক্ষাৎকারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘ব্যর্থতার গ্লানি’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার ভাষ্যে, “জাতীয় নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছিল না। ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার তথ্য থেকেই নির্বাচনের প্রকৃতি বোঝা যায়।”
এছাড়া, তৎকালীন জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
এদিকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার পতন ঘটে। এরপর হাইকোর্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের রায় দেয়। হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, “আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার।”
আ. দৈ./ কাশেম