ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, আ'লীগের পরিণতি হচ্ছে জামায়াতের মত। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু আমরা মানুষ তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানতেই নারাজ। আমরা মানতে নারাজ হলেও আজ হোক বা কাল; প্রকৃতি তার নিয়মেই প্রতিশোধ নেবেই। যেমনটা প্রতিশোধ নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের বেলায়। কে ভেবেছে- এতো তাড়াতাড়ি প্রকৃতি এতো বড় প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু নিয়েছে। অপ্রতিরোধ্য ভাবে চলতে থাকা ধারাকে সারাজ্ঞান না করা আওয়ামী লীগের পতন হলো ছাত্রদের মাত্র এক মাসের আন্দোলনে।
অথচ এই আওয়ামী লীগ বিগত ১৬ বছর তাদের বিরোধীদের উপর চালিয়ে এসেছে সীমাহীন নির্যাতন নিপিড়ন। অভিযোগ রয়েছে- বিরোধ দল ও মতের অনেক মানুষকে গুম-খুনের। তাদের ভিশন ছিলো ২০৪১ সাল পর্যন্ত। দেশের বেশির ভাগ মানুষও মনে করতেন এর আগে আওয়ামী লীগকে নামানো সম্ভব না; যদি না আল্লাহ কিছু করেন।
আওয়ামী লীগ যে বড় দুটি দলকে প্রতিদ্বন্দী মনে করতো তাদের একটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। আরেকটি জামায়াতে ইসলামী। ক্ষমতায় যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় জামায়াতে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার ফাঁসি দেয়। সবশেষ গেল বছর বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে দলটির বিরুদ্ধে। তখন অনেকেরই ধারণা ছিলো একটি বিশেষ দেশকে খুশি করতে দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীকে হত্যা করা হয়।
আদর্শিক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে এক সময় যে অবস্থার মধ্যে ফেলেছিলো সেই সংকটময় পরিস্থিতি এখন আওয়ামী লীগের। ঠিক মুদ্রার ওপিঠ। মুদ্রার যে পিঠে জামায়াত ছিলো-এখন সেই পিঠে আওয়ামী লীগ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে ভারতে পালিয়ে চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এখনও ভারতেই আছেন। অসংখ্য নেতাকর্মীকে অনিশ্চয়তায় রেখে তার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কেউ ভালোভাবে দেখছেন না। এর আগে তিনি বারবারই গর্ব করে বলেছেন শেখের বেটি পালায় না। কিন্তু নিয়তির কি নির্মম পরিহাস! অবশেষে তাকে পালাতে হলো। তিনি পালিয়ে গেলেও অনেক মন্ত্রী এমপি পালাতে পারেন নি।
তাদের মধ্যে অনেকেই ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রকাশ্যে মাঠে নামতে পারছেন না আওয়ামী লীগের কেউ। ঠিক এমন পরিস্থিতি তৈরি করে ছিলো আওয়ামী লীগ। তার ক্ষমতা যাওয়ার পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সভা সমাবেশ এ পর্যায়ে বন্ধ করে দেয়। গ্রেপ্তার করেই বলা হতো নাশকতার পরিকল্পনার সময় জামায়াত শিবিরের নেতাকর্মী গ্রেপ্তার। কোথাও কোনো ঘরোয়া সভা করলেও বলা হতো নাশকতার পরিকল্পনা করছিলো জমায়াতে ইসলামী।
এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলো-যে জামায়াত শিবিরের কোনো সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হতো না। কারণ তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিলো- জামায়াত শিবির যুদ্ধাপরাধীর দল, নাশকতার দল, আগুন সন্ত্রাসের দল। সবশেষ ছাত্র অন্দোলনের সময় তড়িঘড়ি করে জামায়াতের ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। তারই কয়েকদিনের ব্যবধানে ঠিক একই অবস্থার মুখোমুখি আওয়ামী লীগ। এই দলটি সহসা আর রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালাতে পারবে না-গত বৃহস্পতিবার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের ( কেবিনেট) বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলন করে এ বিষয়টি জানান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
যদিও দলটি নিষিদ্ধ করতে আদালতে রীট দাখিল করা হয়। কিন্তু আদালত রীট খারিজ করে দিয়েছে। তবে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে আওয়ামী লীগে ফ্যাসিবাদী দল আখ্যা দিয়ে দলের কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে গণহত্যার বিচার না হওয়ার পর্যন্ত দলটি সব রাজনেতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকবে। একই সঙ্গে গণভবনকে জাদুঘর বানোনোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে।
কোটা সংস্কারের দাবীতে গত জুন থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামেন। তারা শান্তিপূর্ন ভাবেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে যান। সেখান থেকে ফিরে ১৫ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেন। এই সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যে আন্দোলনকারীদের আশার প্রতিফলন ঘটেনি। বরং তাদের উপর ওই রাতেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীদের নেতাকর্মীদের উস্কে দেন।
পরদিনইবদলে যায় আন্দোলনের চিত্র। এরপর কোটা আন্দোলন রুপ নেয় এক দফার আন্দোলনে। তখন আন্দোলন শুরু হয় সরকার পদত্যাগের। পরিস্থিতি আলোচনার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা না করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয় ছাত্রদের প্রতিহত করার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালায়। তাদের গুলিতে অন্তত ৮ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। তার দলের নেতাকর্মীরাও গা ঢাকা দিয়েছে। অনেকে গ্রেফতার হয়ে এখন বিচারের মুখোমুািখ। শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করলেও তাকে ফেরত এনে বিচারের দাবী উঠেছে। ঠিক যেটা আওয়ামী লীগ করেছিলো জামায়াতে ইসলামীর বেলা- সেরকমই এখন হচ্ছে তাদের বেলায়।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘দল হিসেবে আমাদের সঙ্গে যে বৈরী আচরণ করা হয়েছে, আমাদের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছে, আমাদের অফিস কেড়ে নেওয়া হয়েছে, স্বস্তির সঙ্গে আমাদের চলতে দেওয়া হয়নি, দফায় দফায় নির্যাতন করা হয়েছে বিভিন্নভাবে, শেষ পর্যন্ত দিশেহারা সরকার আমাদের নিষিদ্ধ করে তাদের কলিজা ঠান্ডা করেছে। আমরা বলেছি যে আমরা প্রতিশোধ নেবো না। এর মানে হচ্ছে আমরা আইন হাতে তুলে নেবো না। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অপরাধ যিনি করেছেন তার বিরুদ্ধে মামলাও হবে। তাকে শাস্তি পেতে হবে। গণহত্যার বিচার করতে হবে, আবার সাড়ে ১৫ বছর ধরে যেসব অপরাধ করা হয়েছে তারও বিচার করতে হবে।’
আ. দৈ. /কাশেম/ আরিফ