জাতীয় সংলাপে গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচনের সংস্কার নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত এসেছে। গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তাগিদ দিয়ে কয়েকজন বক্তা নির্বাচিত সদস্যদের মাধ্যমে নতুন করে সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দেন। কেউ কেউ সংস্কার করেই নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেন। আবার কারও কারও অভিমত, সংস্কার চলমান প্রক্রিয়া, নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষেই নির্বাচন দেওয়া প্রয়োজন। আরেক বক্তা বলেন, ২ হাজার শহীদ হওয়ার পর এখন রাজনৈতিক সংস্কার সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে আর কখনোই সম্ভব হবে না।
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ‘ঐক্য সংস্কার নির্বাচন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপের শেষ দিন গতকাল শনিবার ‘সংস্কারের দাবি ও নির্বাচনের পথরেখা’ পর্বে এসব প্রসঙ্গ উঠে আসে। এ সংলাপের আয়োজন করে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে শ্রম ও নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন তরুণদের উদ্যোগে হতে যাওয়া রাজনৈতিক দলকে অনুৎসাহিত না করার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হলে সংস্কারও হবে। তবে যারাই ভবিষ্যতে সরকার গঠন করবে, তাদের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
উপদেষ্টা আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ২ হাজারেরও বেশি তরুণ রক্ত দিয়েছে। আরও ২ হাজার হাসপাতালে। এই সময়ে যদি কিছু সংস্কার করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে কখনও করা যাবে না। এটা না করলে শহীদদের প্রতি অন্যায় করা হবে। বাংলাদেশে পলিটিক্যাল পার্টি অ্যাক্ট প্রণয়ন জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগের রাজনৈতিক দল চলেছে এস আলমের টাকায়। আর এখন বলা হচ্ছে, সামনে নির্বাচন, টাকা লাগবে। মানে, চাঁদাবাজি চলছেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ৫ আগস্টের প্রেক্ষাপটে যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করি না। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মত যেটা, সেটা গ্রহণ করতে হবে। আর সেটা হলো গণতন্ত্র। যাদের ওপর সরকার চালানোর দায়িত্ব পড়েছে, তারা যে পরামর্শ দেবে, তাতে যেন আমাদের সমস্যা দূর হয়। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টেরও প্রসঙ্গ তুলে ধরেন তিনি।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নূরুল কবীর বলেন, নির্বাচন হলেই গণতন্ত্র নিশ্চিত হয় না। জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ হতে হবে। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে এরশাদ অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু এরশাদ কি ইসলামী জীবনযাপন করতেন। এটা করে ইসলামের কোনো লাভ হয়নি। বরং ইসলাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মের নামে রাষ্ট্র অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন আমলেও আমরা এ রকম আলোচনা-সমালোচনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে দেখেছি। তখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারী নামে একজন দল গঠনের জন্য অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। সেসব আলোচনায় অনেকে ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার জন্য যোগ দিয়েছেন। রাজনৈতিক সংস্কারের নামে নির্বাচন প্রলম্বিত করে রাজনৈতিক দল গঠন করা সুখকর নয়। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি নির্বাচনমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করুক, তাহলেই মানুষের আস্থা ফিরবে।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইউম বলেন, সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। এটা এমন নয়, রাতারাতি সব সংস্কার হয়ে যাবে। নির্বাচনের বাইরে গিয়ে সংবিধান সংস্কারের বিধান রাখতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেয়ে রাজনৈতিক সম্প্রীতি বেশি প্রয়োজন। আমরা চাই, সব ধর্মের মানুষ ধর্ম পালন করবে। বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। যারা বলছে ক্ষমতায় গিয়ে সংস্কার করবে– এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার আগেই একটা ভিত্তি তৈরি হওয়া দরকার।
গীতিকার শহিদুল্লাহ ফরাজী বলেন, সাম্য যদি তৈরি করতে না পারি, তাহলে আরেকটি ৫ আগস্ট আসার আশঙ্কা তৈরি হবে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, সংস্কার ও নির্বাচনকে সাংঘর্ষিক করে ফেলা হচ্ছে। এই জায়গা থেকে বের হওয়া দরকার। ঐক্যের ভিত্তিতেই পথরেখাটা তৈরি করতে হবে। না পারলে সংকটে পতিত হতে পারে। ভালো সংবিধানের জন্য গণপরিষদের নির্বাচন দরকার বলে মত দেন তিনি।
অধ্যাপক রাশেদ আল তিতুমীর বলেন, অধিকাংশ মানুষের ন্যূনতম ঐকমত্য প্রয়োজন। তার পরই এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়নেরও প্রস্তাব দেন তিনি।
ছাত্রদলের রিসার্চ সেলের সদস্য হাবিবুর রহমান বলেন, এই সরকারের একজনেরও গভর্ন্যান্স অভিজ্ঞতা নেই। বৈষম্যবিরোধীরা সরকারের ওপর আকাশকুসুম প্রত্যাশা তৈরি করেছে। সেনাবাহিনীর ক্যান্টনমেন্টে বসে সরকার গঠন করবেন আর বিপ্লবী সরকার গঠনের কথা বলবেন, সেটা হয় না। এটা অন্তর্বর্তী সরকার, তার পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব না।
নাগরিক কমিটির নির্বাহী কমিটির সদস্য সারোয়ার তুষার বলেন, আমাদের লক্ষ্য নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচনের জন্য সংস্কার– এটা আমরা দ্বিমত করি। এই মুহূর্তে গণপরিষদ নির্বাচনের আয়োজন করে সংবিধান প্রণয়ন করবে। পরে তারাই সরকার গঠন করবে।
আ. দৈ/ আফরোজা