শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫,
৫ মাঘ ১৪৩১
ই-পেপার

শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
জাতীয়
সড়কে শ্রমিক সংগঠনের নামে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি
নিজস্ব প্রতিবেদক
Publish: Saturday, 28 December, 2024, 1:25 PM  (ভিজিট : 38)
দেশে সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম যশোরের বারীনগর বাজার। সেখান থেকে সবজিবাহী একটি ট্রাককে ২০০ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিতে নড়াইল, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, যাত্রাবাড়ীসহ অন্তত সাতটি পয়েন্টে

দেশে সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম যশোরের বারীনগর বাজার। সেখান থেকে সবজিবাহী একটি ট্রাককে ২০০ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিতে নড়াইল, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, যাত্রাবাড়ীসহ অন্তত সাতটি পয়েন্টে

দেশে সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম যশোরের বারীনগর বাজার। সেখান থেকে সবজিবাহী একটি ট্রাককে ২০০ কিলোমিটার মহাসড়ক পাড়ি দিতে নড়াইল, কাশিয়ানী, মুকসুদপুর, ভাঙ্গা, যাত্রাবাড়ীসহ অন্তত সাতটি পয়েন্টে ৫০ টাকা করে মোট ৩৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এ চাঁদা নেয়া হয় সড়কের শ্রমিক সংগঠনের পরিচালন ব্যয় বাবদ। খাতসংশ্লিষ্টদের হিসাবে, এভাবে শুধু সংগঠনের পরিচালন ব্যয় হিসাবেই সারা দেশের সড়ক থেকে প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ চাঁদার প্রভাব পড়ছে নিত্যপণ্যের দামে। বাজার হয়ে উঠছে ঊর্ধ্বমুখী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শ্রমিক সংগঠনের নামে তোলা এ চাঁদার অর্থ চলে যাচ্ছে স্থানীয় রাজনীতিক, পুলিশ ও প্রভাবশালীদের পকেটে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সড়কের চাঁদাবাজি বন্ধ করে নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।

শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেন শাজাহান খান। স্বল্প সময়ের মধ্যেই শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি হন তিনি। আর সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে বসান যথাক্রমে ওসমান আলী ও মোকলেছুর রহমানকে। এ দুজনের মাধ্যমে শ্রম আইন এবং সড়ক পরিবহন আইনকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ একটি নির্দেশিকা জারির মাধ্যমে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিক সংগঠনের কল্যাণ ও পরিচালন ব্যয় বাবদ ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা শুরু করেন শাজাহান খান। এ চাঁদা তোলা হচ্ছে এখনো।

চাঁদা আদায়ের জন্য সারা দেশে ২৪৯টি বেসিক ইউনিয়ন তৈরি করে শ্রমিক ফেডারেশন। তারা মূলত জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের নামে বিভিন্ন সড়কে এ চাঁদা তুলছে। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৪২১ দিনে প্রতিটি যান থেকে ৫০ টাকা করে মোট ৬ হাজার ৯৪ কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়েছে। বার্ষিক হিসেবে এ অংক দাঁড়ায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

শ্রমিক সংগঠনের পরিচালন ব্যয় বাবদ আদায় করা চাঁদাবাজির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন। এর অন্যতম ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। সংগঠনটির দাবি, সারা দেশে সিএনজি, এলপিজি, পেট্রলচালিত চার স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা আছে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪১৩টি। এসব অটোরিকশা থেকে শ্রমিক সংগঠনের পরিচালন ব্যয় বাবদ ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন শুধু এ অটোরিকশা থেকেই চাঁদা আদায় হয় ১ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ টাকা। একইভাবে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৫টি অটোটেম্পো, ৫৫ হাজার ২৮৩টি বাস, ৯ হাজার ৫৪৪টি কার্গো ভ্যান, ৪৮ হাজার ৩৫৮টি কাভার্ড ভ্যান, ১৭ হাজার ৩৮৩টি হিউম্যান হলার থেকে ৫০ টাকা হারে দৈনিক চাঁদা আদায় করা হয়। এর বাইরে ২৮ হাজার ৩৬৯টি মিনিবাস, ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭২টি পিকআপ, ৭ হাজার ৩০টি ট্যাংকার, ৩৬ হাজার ১১১টি ট্যাক্সিক্যাব এবং ১ লাখ ৫২ হাজার ১৩১টি ট্রাক থেকে একই হারে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হচ্ছে।

যদিও সড়ক পরিবহন আইনে এভাবে চাঁদা তোলার ওপর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইনের ৩৮ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে নির্ধারিত টার্মিনাল চার্জ ছাড়া কোথাও কোনো টার্মিনালে পরিবহন যান বা মোটরযান প্রবেশ বা বের হওয়ার সময় অথবা সড়ক, মহাসড়ক ও পাবলিক প্লেসে চলাচলের সময় যানবাহন থেকে কোনো ধরনের অর্থ অবৈধভাবে আদায় করা যাবে না।

ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সড়ক আইনে শ্রমিক সংগঠনের কল্যাণ বা পরিচালন ব্যয় বাবদ টাকা তোলায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে। তার পরও সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূতভাবে শাজাহান খান তার সহযোগীদের মাধ্যমে আদেশ জারি করে দেশজুড়ে চাঁদাবাজি করেছেন। চাঁদার টাকা সংগঠনের কল্যাণে বা পরিচালন ব্যয়ে খরচ না করে সেটা তিনি নিজে এবং রাজনীতিক, পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। আমরা একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী (ওবায়দুল কাদের) এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (আসাদুজ্জামান খান কামাল) সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা কোনো প্রতিকার দেননি। কারণ তারাও সড়কে চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়মিত পেয়েছেন। এবং এ কারণেই এখনো এ চাঁদাবাজি চলমান।’

শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, গাবতলী টার্মিনাল ব্যবহার করে ১২০টি কাউন্টারের মাধ্যমে ৩৭ জেলায় প্রায় ৯০০ বাস চলাচল করে। এর বাইরে ঢাকা-পাটুরিয়া রুটে সেলফি পরিবহন নামে একটি সার্ভিসের কয়েকশ বাস চলে। গাবতলী থেকে সাটুরিয়া-ঘিওর-মানিকগঞ্জ রুটের যানবাহন মালিকদের রয়েছে বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ। তাদেরও রয়েছে তিন শতাধিক বাস। ঢাকা-নবীনগর রুটেও আছে আলাদা কমিটি। এছাড়া ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটেও গাবতলী থেকে কিছু বাস চলে। প্রতিটি বাসকেই নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া গাবতলীর অদূরে মিরপুর ১ নম্বর শাহ আলী মাজারের সামনে প্রতি রাতে দুই শতাধিক সবজির ট্রাক আসে। সেখান থেকেও চাঁদা তোলা হয়। ক্ষেত্রভেদে প্রতিটি গাড়িকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হতো। এমনকি যেসব বাস টার্মিনাল ব্যবহার করত না, সেগুলোকেও চাঁদা দিতে হতো বলে পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন।

ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু গাবতলী টার্মিনালকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন খাতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদা উঠেছে। ৫ আগস্টের পর চিহ্নিত চাঁদাবাজদের অনেকেই পালিয়েছেন। তবে চাঁদাবাজি এখনো বন্ধ হয়নি। পুরনোদের বদলে এখন চাঁদা তুলতে দেখা যাচ্ছে নতুন লোকজনদের।

শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরপুরের (ঢাকা-১৪) প্রয়াত এমপি আসলামুল হক দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণ করেছেন গাবতলী টার্মিনাল। তার লোকজন পরিবহন থেকে বেপরোয়াভাবে চাঁদা তুলতেন বলে অভিযোগ আছে। সে সময় আসলামুল হকের ভাই মফিজুল হক বেবু গাবতলী টার্মিনালে অত্যন্ত দাপুটে হয়ে উঠেছিলেন। তার নিজের কোনো পরিবহন ব্যবসা না থাকলেও শ্রমিক ফেডারেশনের নেতা হিসেবে মালিক সমিতিতে পর্যন্ত ব্যাপক মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি।

২০২১ সালের ৪ এপ্রিল আসলামুল হক মারা যাওয়ার পরেও মফিজুল হক বেবুর প্রভাব কমেনি। পরবর্তী এমপি আগা খান মিন্টুকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি চালিয়েছেন বেবু। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকা-১৪ আসনের এমপি হন মাইনুল হোসেন খান নিখিল। তিনি টার্মিনালের নতুন নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন।

ঢাকা জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাজী মোহাম্মাদ আলী সুবা, সহসভাপতি জলিলুর রহমানের মাধ্যমে সায়েদাবাদ টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলেছিলেন শাজাহান খান। এর বাইরে মিরপুর অঞ্চলের বাস, মিনিবাস থেকে চাঁদা আদায় করতেন ঢাকা মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগ উত্তরের বর্তমানে পলাতক সাধারণ সম্পাদক কালু শেখ। কালু শেখ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস হাফিজুর রহমান লিকুর ঘনিষ্ঠ সহচর। হাফিজুর রহমান লিকুও এ চাঁদার টাকার ভাগ পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সড়ক ও মহাসড়কের চাঁদাবাজি-ছিনতাই বন্ধে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চাঁদাবাজির খবর যেখানেই পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জনগণের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতেও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। চাঁদাবাজি-ছিনতাইসহ যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম রোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

আ. দৈ/ আফরোজা 


আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

বায়ুদূষণে দেশে প্রতি বছর ১ লাখেরও বেশি মানুষের অকাল মৃত্যু
অগ্নিদগ্ধ হয়ে হাসপাতালে কবি নজরুলের দৌহিত্র
'২০-২৫ মিনিটের ব্যবধানে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছি': শেখ হাসিনা
কিছু দুষ্টু লোক আমাদের সম্প্রীতিতে ফাটল ধরাতে চায়: মিজানুর রহমান আজহারী
দুদকের মামলায় বিএফআইইউ'র মাসুদ বিশ্বাস কারাগারে,রিমান্ড শুনানি রোববার
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ফরিদপুরে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতারা গন সংযোগে ব্যস্ত
দুদকের মামলায় বিএফআইইউয়ের মাসুদ বিশ্বাস গ্রেপ্তার
চায়না পোশাকে সয়লাব দেশ
দক্ষতা ও নিষ্টার পুরস্কার, দুদকের মহাপরিচালক-পরিচালক পদে পদোন্নতি
রাজনৈতিক ঐক্যে যাতে ফাটল না ধরে: সালাউদ্দিন
জাতীয়- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : [email protected]
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝