সিরিয়ায় দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আসাদ পরিবারের শাসনের হঠাৎ পতনে বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটে। এর আগে তার বাবা হাফিজ আল-আসাদ টানা তিন দশক সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
বর্তমানে সিরিয়ার ক্ষমতায় এসেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে ক্ষমতাচ্যুত আসাদ, তার স্ত্রী আসমা এবং তাদের সন্তানরা রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। রুশ সরকার তাদের মানবিক বিবেচনায় আশ্রয় দিয়েছে। তবে আসাদ পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
আসাদ পরিবারের বর্তমান অবস্থান
রুশ সরকারি গণমাধ্যম জানায়, দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ হারানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আসাদ পরিবার মস্কোয় পৌঁছায়। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, রাষ্ট্রপ্রধানের অনুমোদনেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাশিয়া ও আসাদ পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রমাণ রয়েছে। ২০১৯ সালে দ্য ফিন্যানশিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আসাদ পরিবার মস্কোতে বিলাসবহুল ১৮টি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিল। এই সম্পত্তি মূলত গৃহযুদ্ধের সময় বিদেশে অর্থ পাচারের অংশ হিসেবে কেনা হয়েছিল।
আসমা আল-আসাদের ভবিষ্যৎ
আসাদের স্ত্রী আসমা আল-আসাদ যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পশ্চিম লন্ডনে। তিনি একজন সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস থেকে পড়াশোনা শেষে তিনি সিরিয়ায় যান এবং আসাদকে বিয়ে করেন।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সেসের ভিজিটিং ফেলো ড. নাসরিন আলরেফাই বিবিসিকে বলেন, আসমা চাইলে যুক্তরাজ্যে ফিরে যেতে পারেন, কারণ তার ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তার বাবার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় আসমা হয়তো রাশিয়াতেই থাকতে চাইবেন।
আসমার বাবা ড. ফাওয়াজ আল-আখরাস একজন কার্ডিওলজিস্ট এবং মা সাহার একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। তারা বর্তমানে রাশিয়ায় অবস্থান করছেন। মেইল অনলাইনের এক প্রতিবেদন অনুসারে, আসাদ দম্পতির তিন সন্তান—হাফিজ, জেইন এবং কারিমও তাদের সঙ্গে রয়েছেন।
বিচারের মুখোমুখি হবেন আসাদ?
আসাদের ক্ষমতা হারানোর পর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে জোর আলোচনা চলছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেছেন, আসাদ সরকারের অধীনে সিরিয়ার মানুষ যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, ব্যারেল বোমা হামলা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের জন্য আসাদ ও তার প্রশাসনের বিচার হওয়া উচিত।
২০১৩ সালের রাসায়নিক হামলার ঘটনায় আসাদের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া সাধারণত অন্য দেশের নাগরিকদের নিজ ভূখণ্ড থেকে প্রত্যর্পণ করে না। ফলে মস্কোতে আশ্রয় নেওয়া আসাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়া কঠিন হবে।
বিদ্রোহী নেতা আবু মোহাম্মেদ আল-জোলানি জানিয়েছেন, তারা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্ত করবে এবং সিরিয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তাদের দেশে ফেরাতে চেষ্টা করবে। এদিকে, রুশ গণমাধ্যম জানায়, রাশিয়ার কর্মকর্তারা সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে যেন রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনের কোনো ক্ষতি না হয়।
আসাদ পরিবারের সম্পদ ও বিতর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ২০২২ সালে কংগ্রেসে দেওয়া এক প্রতিবেদনে জানায়, আসাদ পরিবারের সম্পদ ১ থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে হতে পারে। তবে এই সম্পদ অফশোর কোম্পানি, রিয়েল এস্টেট এবং বিভিন্ন করপোরেশনের মাধ্যমে লুকানো থাকায় সঠিক হিসাব করা কঠিন।
আসাদ ও তার স্ত্রী আসমা সিরিয়ার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের পরিবার সিরিয়ার ব্যবসায়ী এলিটদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতেন। সিরিয়া ট্রাস্ট ফর ডেভেলপমেন্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠান, যা বিদেশি ত্রাণ ও সহায়তা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল, সেখানে আসমার ব্যাপক প্রভাব ছিল।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আসমাকে "সিরিয়ার যুদ্ধ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবানদের একজন" হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা আসমাকে "পরিবারের অর্থনৈতিক প্রধান" এবং "একজন অলিগার্ক" হিসেবে উল্লেখ করেন।
রাশিয়া-আসাদ সম্পর্ক ও ভূরাজনীতি
রাশিয়া ২০১৫ সালে আসাদ সরকারের পক্ষে বিমান হামলা চালিয়ে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ওই সময়ের রুশ অভিযানে প্রায় ২১ হাজার মানুষ নিহত হয়, যার মধ্যে ৮,৭০০ জন ছিলেন বেসামরিক নাগরিক। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার মনোযোগ অন্যদিকে চলে যাওয়ায় আসাদের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন দুর্বল হয়ে পড়ে।
বর্তমানে রাশিয়া বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে তাদের সামরিক ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাশিয়া হয়তো আসাদকে আর সমর্থন দিতে আগ্রহী নয় বা সক্ষম নয়।
আসাদের ভবিষ্যৎ কী?
আসাদ পরিবার আপাতত রাশিয়ায় আশ্রয় নিলেও তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারা রাশিয়ায় নিরাপদ থাকতে পারে, কারণ রাশিয়া সাধারণত নিজের আশ্রয়ে থাকা ব্যক্তিদের অন্য দেশে প্রত্যর্পণ করে না। তবে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের অভিযোগে আসাদ এবং তার পরিবারের বিচারের দাবি জোরালো হচ্ছে।
আসাদের স্ত্রী আসমা চাইলে যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারেন, তবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং তার বাবা-মায়ের অবস্থানের কারণে তিনি রাশিয়ায় থাকতে পছন্দ করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়ার শক্তিশালী ভূমিকা ছিল, যা আসাদ সরকারের পতন ঠেকাতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তবে আসাদের পতনের পর তার ভবিষ্যৎ এখন রাশিয়ার দয়ার ওপর নির্ভর করছে। রাশিয়ার ভেতরে থাকা অবস্থায় আসাদ এবং তার পরিবারের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ বাড়লে এবং সিরিয়ার নতুন সরকার যথেষ্ট কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।
আ. দৈ./ সাধ