বাংলাদেশে বিদ্যুতের চড়া দামের অন্যতম কারণ হিসেবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া ক্যাপাসিটি পেমেন্টকে (ক্যাপাসিটি চার্জ) দায়ি করা হয়েছে। এই পেমেন্ট গত কয়েক বছর ধরে বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় বিপুল পরিমাণে বাড়িয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশের বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার প্রায় ৪১ শতাংশ অব্যবহৃত ছিল। কেবল ২০২৩ অর্থবছরেই সরকার ২৬ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে।
আজ শুক্রবার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে তিন দিন ব্যাপী ‘বাংলাদেশ জ্বালানি সমৃদ্ধি ২০৫০’ সম্মেলনের সমাপনী দিনে বিশেষজ্ঞর এই দাবি করেছেন।
একই সঙ্গে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে এই নীতি, নবায়নযোগ্য শক্তি সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম আমদানিতে শুল্ক কমানোর দাবিও জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রে ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পে’ এমন নীতি কার্যকর হলে তা দেশের আর্থিক বোঝাও অনেক কমবে।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয়, সেটাকেই ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়।
অপরদিকে তারা দেশে নবায়নযোগ্য শক্তিখাত পুরোদমে চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত বৃহদাকার ও গৃহস্থালিতে সৌর বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানিতে সব ধরনের আমদানি শুল্ক কমানোরও দাবিও জানিয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকার কেন এখন পর্যন্ত কোনো নেট-জিরো টার্গেট ঠিক করতে পারেনি, এমন প্রশ্ন করে বুয়েট অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয় এখনও বাংলাদেশের নেট-জিরো লক্ষ্য ঘোষণা করেনি। আর এই কারণেই দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে না।
এ প্রসঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার সমাপনী বক্তব্যে বলেন, আমাদের ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনে (এনডিসি) দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো অর্জন করাও খুবই চ্যালেঞ্জিং।
তিনি বলেন, অন্য মন্ত্রণালয়ের সমর্থন পেলে অর্জন করা সম্ভব এমন নেট-জিরো লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশও ঠিক করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা এখনও বিগত সরকারের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। একই সঙ্গে আমরা পরিবর্তন আনার সুযোগও পেয়েছি।
অনুষ্ঠানে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সমন্বিত বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) অবশ্যই বাতিল হওয়া উচিত। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এবং বিদ্যুৎ মিশ্রণে নবায়নযোগ্য শক্তির পরিমাণ বাড়ানো এমন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি বিদ্যুৎ-জ্বালানি মহাপরিকল্পনা বানানো ও কার্যকর করা উচিত।
তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, যা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছিল না, তা নিশ্চিত করার ওপরও জোর দেন।
বাংলাদেশ সোলার অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জাহিদুল আলম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংশ্লিষ্ট মালামালের আমদানি শুল্ক কমানো না গেলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কখনই ৩০ শতাংশ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবে না।
নীতিনির্ধারক, অ্যাকাডেমিক, গবেষক, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, জ্বালানি কোম্পানি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জলবায়ু ও মানবাধিকার কর্মী, আদিবাসী সম্প্রদায়, তরুণ, ছাত্র এবং ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রায় ৪০০ প্রতিনিধির পক্ষে বিডব্লিউজিইডি-র সদস্য সচিব হাসান মেহেদী শেষ দিন সম্মেলনের ঘোষণা পাঠ করেন।
এ ঘোষণায় নীতি সমন্বয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও পদক্ষেপগত সংস্কার, কার্যকর আর্থিক পদ্ধতি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সহায়তা বৃদ্ধি এবং আরও উন্নত সামাজিক ও পরিবেশগত সুশাসনের মতো বিষয়ে জরুরিভিত্তিতে মনোযোগ দেওয়ার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
ক্যাপাসিটি চার্জটা পুরো বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে দুটি বড় ব্যয় রয়েছে - একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য এবং আরেকটি হলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়। ক্যাপাসিটি চার্জটা উৎপাদন ব্যয়ের অন্তর্ভূক্ত।
বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইকোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিডব্লিউজিইডি), সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিসিয়েটিভ (এমআরডিআই), বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল’ইয়ারস অ্যাসোসিয়েশন (বেলা), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), অ্যাকশন এইড বাংলাদেশসহ প্রায় দুই ডজন সংগঠন যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজন করে।
বিবিসি বাংলা ২০২৩ সালের ছয় সেপ্টেম্বরের এক প্রতিবেদনে জানায়, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী তাদের যে পরিমাণ ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয়, সেটাকেই ক্যাপাসিটি চার্জ বলা হয়।
সাবেবক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সালের পাঁচ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছেন, ২০০৯ সালের পর থেকে সরকার ৮২টি বেসরকারি এবং ৩২টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এক লাখ চার হাজার ৯২৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিশোধ করেছে।
ওই প্রতিবেদনে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহম্মদ হোসাইন বলেন, ‘ক্যাপাসিটি চার্জটা পুরো বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার একটি অংশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে দুটি বড় ব্যয় রয়েছে - একটি হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির মূল্য এবং আরেকটি হলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়। ক্যাপাসিটি চার্জটা উৎপাদন ব্যয়ের অন্তর্ভূক্ত।
পিডিবির ক্ষেত্রে নিজস্ব উৎপাদন কেন্দ্র থাকায় তাদের এই ক্যাপাসিচটি চার্জ হিসাব করা হয় না। তবে বেসরকারি উদ্যোগের ক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তা সব ব্যয় অন্তর্ভূক্ত করেই হিসাব করে।
আ. দৈ/ আফরোজা