রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫,
১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার

রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
মতামত
‘সময় পেলে সেফ হোম নিয়েও কথা কয়েন’
গওহার নঈম ওয়ারা
Publish: Sunday, 20 October, 2024, 1:15 PM  (ভিজিট : 92)

দুজন বন্দীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল কথিত এক সেফ হোমে। সেখানে আটক এই দুই মেধাবী কিশোরীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয় সেবার। শিরোনামের অনুরোধটা ছিল তাদেরই।

দুই বোন-দুজনই এসএসসিতে সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছিল। পাঠক্রমের বাইরেও তাদের অনেক জানাশোনা। প্রমিত বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও ভালো বলে। উচ্চমাধ্যমিক পড়তে পড়তে দুই বোনের ‘মতিভ্রম’ (তাদের অভিভাবক এবং সেফ হোমের কর্মকর্তাদের মতে) ঘটে। দুই বোন তাদের পরিবারের ধর্ম ত্যাগ করে। এর ফলে তাদের লেখাপড়া বন্ধ আর সেফ হোমে প্রেরণ। সেফ হোমটিতে বেশির ভাগই হচ্ছে সরকার নির্ধারিত বয়সের আগে বিয়ে করে ফেঁসে গেছে এমন। পরিবার দিয়েছে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা। ছেলেটি ধরা পড়ে জামিন অযোগ্য হাজতবাসে আছে। আর কিশোরীটির দিন কাটছে অসহ্য এক বন্দিখানায়। এদের কয়েকজন সদ্য মা হয়েছে এমনও আছে। 

মাঝেমধ্যেই সেফ হোমের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়। তবে বেশির ভাগ খবরে থাকে সেফ হোম থেকে কিশোরীদের ‘পালিয়ে’ যাওয়ার ঘটনা। সম্প্রতি ছাপা হওয়া একটা খবর পড়ে মনে হতে পারে, এটা একটা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’। কিন্তু তিন-চারটা দপ্তরের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ঘটা সে ঘটনা কতটা তাৎক্ষণিক অথবা কতটা নিয়মিত, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। অপহরণ থেকে উদ্ধারের পর ঠাকুরগাঁওয়ের এক কিশোরীকে নিরাপত্তার কারণে রাজশাহী সেফ হোমে রাখা হয়।

দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সময় এই ব্যবস্থাপনারও বারোটা বাজানো হয়েছে। জেল কোডের আদলে প্রতিটি আটক কেন্দ্রে (সেফ হোম, কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, ভবঘুরে পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি) নিরপেক্ষ পরিদর্শক দল গঠন এখন সময়ের দাবি

সেই কিশোরীকে সম্প্রতি সরকারি ব্যবস্থাপনায় ঠাকুরগাঁওয়ে নিয়ে গিয়ে আসামিদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেয়া হয়। পুলিশ, রাজশাহীর সেফ হোমের সুপারিনটেনডেন্ট এবং ঠাকুরগাঁও সমাজসেবা দপ্তরের প্রবেশন অফিসারদের চতুর সমন্বয় ছাড়া এ ধরনের দেখা-সাক্ষাৎ একেবারেই অসম্ভব। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভুল স্বীকার করে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন রাজশাহীর সেফ হোমের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট। যাঁর কথায় তিনি কিশোরীটিকে ঠাকুরগাঁও পাঠিয়েছিলেন, সেই প্রবেশন অফিসার (সমাজসেবা কার্যালয় ঠাকুরগাঁও) কিংবা পুলিশ, যাঁদের চাঁদোয়ার নিচে আসামিরা কাণ্ডটা ঘটাল, তাদের কোনো কৈফিয়ত কি চাওয়া উচিত নয়?

এ ঘটনা থেকে বোঝা যায়, সেফ হোম কতটা অনিরাপদ। সম্প্রতি একটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে গবেষণার কাজ করতে এসেছিলেন বিদেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। নিবাসীদের সঙ্গে একান্তে কথা বলে তিনি সেখানকার একশ্রেণির কর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ শুনেছেন, তার সিকি ভাগও যদি সত্য হয়, তবে বলতে হবে কিশোরেরা নরকে আছে। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে এর দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিবাসীদের যেকোনো ঝুঁকিতে ফেলতে পরোয়া করে না।

বাংলাদেশে বর্তমানে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গাজীপুর সেফ হোম ছাড়া আরও ছয়টি সেফ হোম আছে। সেগুলোতে মোট ৩০০ জন থাকতে পারেন। সেখানে আছেন মোট ৪৩৩। এর প্রায় অর্ধেকই প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশু। দেশের বাইরেও ছয়টি (রিয়াদ, জেদ্দা, মদিনা, ওমান, জর্ডান, লিবিয়া ও লেবানন) সেফ হোম আছে। সেগুলোকে অবশ্য সেফ হাউস বলা হয়। হোম আর হাউস যা-ই হোক, উভয় জায়গায় নারীদের সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রধান লক্ষ্য। 

প্রথম আলো পত্রিকায় গতবছরের ২৬ জুলাই রাফসান গালিব তাঁর এক লেখায় রিয়াদের সেফ হাউস নিয়ে বিস্তারিত লিখেছিলেন। সেখানে একজন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা দিনের পর দিন আশ্রিত নারীদের হেনস্তা ও ধর্ষণ করছেন। প্রমাণিত হওয়ার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়নি। তাঁকে আইনে সোপর্দ করা হয়নি। সেফ হোমের গরিব-অসহায় নিবাসীদের পক্ষে আওয়াজ তোলার যে কেউ নেই। রাষ্ট্র আর তার আমলাতন্ত্র চোখ বন্ধ করে থাকে।

সেফ হোম বা নিরাপদ আবাসনকেন্দ্রে রাখা হয় বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার ভুক্তভোগী নারী-শিশু-কিশোরীদের। আসলে এই হোমগুলো তৈরি করা হয়েছিল প্রবীণ নিবাস হিসেবে। তখন নাম দেয়া হয়েছিল ‘শান্তিনিবাস’। পরে এক অজানা কারণে এগুলো সেফ হোম করা হয়। বলা হয়েছিল, আইনের সংস্পর্শে আসা মেয়েশিশু, কিশোরী ও নারীরা জেলখানায় ‘অপরাধী’দের সংস্পর্শে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই তাঁদের সেফ হোমে রাখার ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিও প্রতিবন্ধীদের কথা ভেবে বানানো হয়নি। পরে তাঁদের জন্য আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধাও গড়ে তোলা হয়নি। কিন্তু প্রতিবন্ধীদেরও রাখা হচ্ছে এখানে।

একবার এক বন্দী কিশোরী খুবই কাতরভাবে বলেছিলেন, ‘কিছু না পারলে আমাকে জেলখানায় রাখার ব্যবস্থা করুন, কিন্তু এখানে আর নয়।’ খাওয়া দাওয়া থাকার অসুবিধা ছাড়াও সেফ হোমের সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে আত্মীয়স্বজনের বা সাক্ষাৎপ্রার্থীর সঙ্গে দেখা করা। জেলখানায় ভালো হোক-মন্দ হোক একটা ‘সিস্টেম’ দাঁড়িয়ে গেছে। যেটাই হোক, ‘ওয়ান-স্টপ’ সার্ভিস সেখানে গড়ে উঠেছে। খরচ করলে কম সময়ের জন্য হলেও দেখা করা সম্ভব। তাছাড়া সব জেলা সদরেই জেলখানা আছে কিন্তু সেফ হোম বিভাগে একটা।

কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত এলাকা ফিলিপনগর চরের কোনো পিতা যদি সেফ হোমের হেফাজতে থাকা তাঁর কন্যাকে দেখতে খুলনা বিভাগের সেফ হোম বাগেরহাটে আসেন, তবে সেদিনই তাঁর ফেরা সম্ভব নয়। তা ছাড়া দেখা করার অনুমতি দেয়ার মালিক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা জেলা প্রশাসক। পৃথিবীতে তাঁর মতো ব্যস্ত অফিসার আর নেই। ফলে দিনের পর দিন সেই হতভাগ্য পিতাকে অপেক্ষা করতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক কারণে সেটা সম্ভব হয় না।

সমস্যাগুলো নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ব্রিটিশদের প্রণয়ন করে যাওয়া কারাবিধিতে কারাগার পরিদর্শনের জন্য জেলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কারা পরিদর্শক কমিটি গঠনের ব্যবস্থা আছে। দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের সময় এই ব্যবস্থাপনারও বারোটা বাজানো হয়েছে। জেল কোডের আদলে প্রতিটি আটক কেন্দ্রে (সেফ হোম, কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র, ভবঘুরে পুনর্বাসন কেন্দ্র ইত্যাদি) নিরপেক্ষ পরিদর্শক দল গঠন এখন সময়ের দাবি। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে নেয়া পরিদর্শকেরা নিবাসীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করে তাদের অভিযোগের সুরাহা করার ব্যবস্থা নিতে পারেন।


লেখক: গওহার নঈম ওয়ারা, গবেষক
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

টঙ্গীতে পোশাক কারখানা বন্ধের প্রতিবাদে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
টঙ্গীতে ঝুটের গুদামে ভয়াবহ আগুন, আধাঘণ্টায় নিয়ন্ত্রণে
ইউনিয়ন ব্যাংকেরও শীর্ষ খেলাপি দেশবন্ধু গ্রুপ
শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ৮৯৬তম সভা অনুষ্ঠিত
ইউনিয়ন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভা অনুষ্ঠিত
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী দলের সভা
ঢাকা দুই সিটিতে আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিএনপির ব্যাপক তদবির
পদত্যাগ করলেন আটাবের সবুজ মুন্সী
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১২ বছর , তবু মেলেনি বিচার, নিশ্চিত হয়নি ক্ষতিপূরণ
শিগগিরই ঢাকা শহরে অটোরিকশার ওয়ার্কশপ ও চার্জিং স্টেশন বন্ধে অভিযান: ডিএনসিসি প্রশাসক
মতামত- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝