শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে টানা ৪ দিনের ছুটিকে কেন্দ্র করে মানুষের ঢল নেমেছে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারে। লম্বা ছুটিতে অবকাশ যাপনে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কক্সবাজার ছুটে আসছেন ভ্রমণপিপাসু পর্যটকেরা। শরতের মিষ্টি রোদ, সাদা মেঘের ভেলা কিংবা হঠাৎ বৃষ্টি সমুদ্রপাড়ের প্রকৃতিকে করে তুলেছে আরও মোহনীয়। ফলে কক্সবাজার এখন পরিণত হয়েছে পর্যটকদের মিলনমেলায়।
পর্যটন নগরী কক্সবাজার ও এর আশপাশে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউস ও কটেজে ১ লাখ ৭০ হাজার পর্যটকের জন্য রাতযাপনের ব্যবস্থা রয়েছে। যেগুলো বর্তমানে শতভাগ বুকিং হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। সৈকতজুড়ে উচ্ছ্বাস ও ঘুরাঘুরির পাশাপাশি উৎসবমুখর-আনন্দঘন পরিবেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন উদযাপন করছে তাদের ধর্মীয় মহোৎসব।
এর আগে জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে পর্যটক শূন্য হয়ে পড়েছিল দেশের প্রধান এই পর্যটনকেন্দ্র। তবে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে কক্সবাজারে পর্যটক আসা শুরু হয়। পর্যটন দিবস উপলক্ষে হোটেলগুলোর রুম ভাড়ায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিলেও তেমন পর্যটক ঘুরতে আসেননি। তবে পর্যটকের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা রুম ভাড়ার ওপর ছাড় প্রত্যাহার করে নেন বলে জানা গেছে।
আজ শুক্রবার বিকেলে লাবণী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে গিয়ে দেখা গেছে, সমুদ্রসৈকতে পা ফেলার জো নেই। দীর্ঘদিন নিষ্প্রাণ থাকা সৈকত তীর যেন তার সেই চিরচেনা রূপে ফিরেছে।
এদিন দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সৈকতের এই তিন স্পটে অন্তত ৫০ হাজার পর্যটক সমুদ্র দর্শনে নেমেছেন বলে জানান জেলা প্রশাসনের বিচ-কর্মীদের সুপারভাইজার বেলাল হোসেন। তিনি বলেন, কক্সবাজারে এখন লাখো পর্যটক অবস্থান করছেন।
সমুদ্রসৈকত ছাড়াও কক্সবাজার শহরের কলাতলী মোড় থেকে ৮৪ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে ছুটছেন পর্যটকেরা। এ সড়কে দরিয়ানগর পর্যটনপল্লি, হিমছড়ির জাতীয় উদ্যান, ঝরনা, ইনানী ও পাটুয়ারটেক পাথুরে সৈকত, টেকনাফ, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, রামু বৌদ্ধপল্লি, চকরিয়ার ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক ও নিভৃতে নিসর্গে পর্যটক ভিড় করছেন।
ভ্রমণরত কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে পরিবার নিয়ে কক্সবাজারে এসেছেন উদ্যোক্তা ও গবেষক মো. ওয়াহিদুর সিরাজ বাপ্পী। তিনি রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা। ইনানী বিচে পরিবারের সঙ্গে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করছিলেন।
জানতে চাইলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কাজে-কর্মে বেশ চাপের মধ্যে আছি। সবকিছু এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ৪ দিনের ছুটিতে একটা রিফ্রেশমেন্টের জন্য বান্দরবান যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রুমণ নিষেধাজ্ঞা থাকায় এখানে এসেছি। তবে খুব ভিড় থাকায় এখানে তেমন ভালো লাগছে না।
নরসিংদীর ভেলানগর থেকে সপরিবারে এসেছেন লামইয়া তাবাসসুম মীম’র পরিবার। লামইয়া তাবাসসুম বলেন, সবসময় দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ মেলে না। অনেকদিন ধরে চিন্তা করছিলাম কক্সবাজার আসবো। কিন্তু সেই সময়টুকু পাচ্ছিলাম না। তবে পূজার এই ছুটি সেই সুযোগ করে দিয়েছে।
সুগন্ধা পয়েন্টে ইসমাইল হোসেন ও তাসফিয়া হোসেন নামে এক নবদম্পতির সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, সদ্যমাত্র বিয়ের পর হানিমুনের জন্য প্রথমবারের মতো কক্সবাজার আসলাম। খুবই ভালো লাগছে।
এদিকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হোটেল-মোটেলগুলোতে দেয়া হচ্ছে বিশেষ ছাড়। প্রায় প্রতিটি হোটেল ৪০-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে। খাবারের মেনুতেও যোগ হয়েছে নতুন আকর্ষণ। ২০ অক্টোবর পর্যন্ত চলছে ইলিশ উৎসব, যেখানে ৮ ধরনের ইলিশ রান্নার স্বাদ নেওয়ার সুযোগ থাকছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, এবারের শারদীয় ছুটি আমাদের জন্য বড় ব্যবসার সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। সাত দিনব্যাপী লাখো পর্যটকের আগমনে পুরো পর্যটন খাত চাঙ্গা হবে এবং কয়েক’শ কোটি টাকার বাণিজ্য হবে বলে আমরা আশা করছি।
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের এসপি মাহফুজুল ইসলাম জানান, প্রতিটি পর্যটন স্পট ও সৈকতের প্রবেশ পথে তল্লাশি চৌকি স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য পোশাকধারী এবং সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়োজিত রয়েছে। সৈকতে নিয়মিত টহল এবং পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এছাড়াও পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য যৌথ টহল এবং মোবাইল টিমও কাজ করছে।
বাস পরিবহন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আগামী রোববার পর্যন্ত কক্সবাজারে ৮৫টি কোম্পানির ৮ হাজার বাস আসা-যাওয়া করবে। এসব বাসের বেশির ভাগই টিকিট অগ্রিম বুকিং রয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথে দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিশেষ ট্রেনও চলবে। তবে সেখানেও কোনো আসন খালি নেই।
এদিকে পর্যটকের আগমনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বেলাভূমি কুয়াকাটা সৈকতে। সমুদ্রের গর্জন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ এখানে আসা দর্শনার্থীরা।
তাছাড়া ৩ পার্বত্য জেলায় ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি, রাতারগুলেও। এখানের হোটেল-মোটেলগুলোও ৯০ শতাংশ রুম বুকিং হয়েছে। পাহাড়-টিলা-হাওর-ঝর্ণা, চা বাগানের সৌন্দর্য উপভোগে মৌলভীবাজারে আসছেন ভ্রমণপিপাসুরা। পর্যটকদের নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি থাকছে র্যাব ও সেনাবাহিনীর বিশেষ টহল।
আ.দৈ/এআর