বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবীন ঘটনা, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ থেকে বিপুল পরিমান কয়েক শত কোটি টাকা মূল্যের সাদা পাথর লুট হয়েছে। অবশেষে হাইকোর্ট পাথর লুটের ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জড়িতদের তালিকা চেয়েছেন। একইসঙ্গে লুট হওয়া সব পাথর উদ্ধার করে ৭ দিনের মধ্যে আগের জায়গায় ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
উচ্চ আদালত আগামী দুই মাসের মধ্যে পাথর লুটের সাথে জড়িতদের তালিকা হলফনামা আকারে দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন। লুট হওয়া পাথর যেখানে আছে, সেখান থেকেই উদ্ধার করতে হবে।
আদালতের আদেশে বলা হয়েছে, এ ছাড়া লুট হওয়া পাথর কী পরিমাণ ক্ষতি হলো, সেটা নির্ধারণে একটি কমিটি করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে বুয়েটের একজন অধ্যাপক থাকবেন।
পাশাপাশি সাদা পাথর এলাকা পর্যবেক্ষণে জন্য সব আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে এক মনিটরিং টিম গঠন করতে বলা হয়েছে। আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী বৃহস্পতিবার দিন রেখেছেন।
আদেশের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি জানান, অন্তর্বর্তী আদেশের পাশাপাশি পাথর সংরক্ষণে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, সংরক্ষণ ও ক্ষতিপূরণের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, আইনি ব্যবস্থা কেন নেওয়া হবে না, এই মর্মে রুল জারি করেছেন।
এর আগে আজ বৃহস্পতিবার সকালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন যুক্ত করে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ রিট করা হয়।
‘বিরামহীনভাবে চলছে সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট’- গত ১১ আগস্ট প্রকাশিত এই শিরোনামে প্রকাশি এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট।
সিলেটের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে ভ্রমণ পিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে থাকা এটি বর্তমানে লুটে ক্ষতবিক্ষত স্পটে পরিণত হয়েছে। পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হচ্ছে। অথচ পর্যটন কেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা গণমাধ্যমকে জানায়, ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেত, দেখা যেত সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। তাদের ভাষ্য, এক বছরে এক কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য ২০০ কোটি টাকার বেশি।
সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রের ধলাই নদীর উৎসমুখ থেকে শত শত নৌকা দিয়ে পাথর লুট হচ্ছে। মূল স্পটের বাম পাশের বড় বড় পাথর নেই। কোথাও কোথাও বালুচর জেগে উঠেছে। যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়িও চলছে। বড় পাথরের পাশাপাশি ছোট-ছোট পাথরও লুট হয়ে গেছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। আর দায়িত্বশীলরা বসে বসে সে দৃশ্য দেখছে।
এ ছাড়া পাথর বোঝাই শত শত নৌকার মাঝে পর্যটকবাহী নৌকাও ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। এতে পর্যটকরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশাসনের উদাসীনতা ও টিলেঢালা নজরদারির কারণে পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তার প্রভাব থাকে সামান্য সময়। এরপর আবারও লুটপাট চলে। একটি প্রভাবশালী মহল সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে দাবি তাদের।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান গণমাধ্যমকে জানান, সাদা পাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে। ৭০ জনের মতো আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। স্থায়ীভাবে সাদা পাথর লুটপাট ঠেকাতে বড় অভিযানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সিলেটে লুণ্ঠিত ১২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার:
সিলেটের জেলা প্রশাসন গত ১৩ আগস্ট দিনভর অভিযান চালিয়ে পর্যটন স্পট কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা পাথর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এলাকা থেকে লুন্ঠিত ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করেছে। একই সাথে জাফলংয়ে পাথর পরিবহনে ব্যবহৃত ১০০ টি নৌকা ধ্বংস করেছে।
এসব পাথর আবার সাদাপাথর স্পটে ফিরিয়ে আনা হবে বলে জেলা প্রশাসন জানায়। এ ছাড়া কলাবাড়ি এলাকায় পাথর ভাঙার কাজে ব্যবহৃত বেশ কিছু যন্ত্রের বিদ্যুৎ-সংযোগও বিচ্ছিন্ন করা হ কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহার বলেন, নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে অভিযান চালায় জেলা প্রশাসন। অভিযানে শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে সেনাবাহিনী সহায়তা করে।
একইভাবে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের বল্লাঘাট, ঝুমপাহাড় ও জিরো পয়েন্ট এলাকায়ও বুধবার বেলা একটা থেকে চারটা পর্যন্ত অবৈধ পাথর ও বালু উত্তোলন ঠেকাতে অভিযান চালানো হয়। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার পলি রানী দেব।
অভিযান-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযানে অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনে ব্যবহৃত ১০০টি বারকি নৌকা ভেঙে ফেলা হয়। সেখানে অবৈধভাবে উত্তোলন করা ১৩০ ফুট বালু জব্দ করা হয়।অভিযানের বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার পলি রানী দেব বলেন, জাফলংয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন ও পরিবহনের যুক্ত প্রায় ১০০টি নৌকা আটক করে তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১২ হাজার ঘট ফুট পাথর। অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন রোধে সিলেট জেলা প্রশাসনের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এর আগে, সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রে ব্যাপক লুটপাটের পর জেলা প্রশাসন গত ১৩ আগস্ট একটি ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বলে জানায়। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পদ্মাসন সিংহকে প্রধান করে গঠিত কমিটি পাথর লুটের ঘটনা অনুসন্ধান করে। ১৭ আগস্টের মধ্যে এ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এদিকে সাদা পাথর লুটের ঘটনায় দুদকের অভিযান:
সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর সাদাপাথর উত্তোলনের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানের পরে টনক নড়েছে সংশ্লিষ্টদের। সিলেট বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সার্কিট হাউজে সর্বস্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) দুদক জানায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থাসমূহের অবহেলা ও অসাধু যোগসাজশে সিলেট জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর এলাকা থেকে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুদক, সমন্বিত জেলা কার্যালয়, সিলেট থেকে বুধবার একটি এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করা হয়। এনফোর্সমেন্ট টিমের পর্যবেক্ষণে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, পাথর চুরি রোধের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি দপ্তরগুলো খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে এ পর্যটন এলাকা থেকে কয়েকশ কোটি টাকার সমমূল্যের পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দুদকের অভিযানের পরে সিলেট বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সার্কিট হাউজে সর্বস্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি সভায় জাফলং ইসিএ এলাকা ও সাদাপাথর এলাকায় ২৪ ঘণ্টা যৌথবাহিনীর দায়িত্ব পালন; গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের চেকপোস্ট যৌথ বাহিনীসহ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন; অবৈধ ক্রাশিং মেশিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নসহ অভিযান বন্ধ অব্যাহত রাখা; পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং চুরি হওয়া পাথর উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানকালে এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য শুনেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, দুর্নীতি ও আত্মসাৎ প্রতিরোধে ও প্রতিকারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে অভিযানকালে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম কমিশন বরাবর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করবে।
আ. দৈ./কাশেম