এখনো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র/ প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরটি পরিবার এবং আত্মীয় স্বজনদের প্রভাব মুক্ত হয়নি। বলতে গেলে মেয়র আনিসুল হক থেকে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ পর্যন্ত পরিবারিক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কবলে ডিএনসিসি। পুরো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় তাদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার রক্তক্ষয়ী গণআন্দোলনে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার এবং স্বৈরাচার মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের পতন হয়েছে। এরপর শান্তিতে নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ড.মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্ত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিশেষ যোগ্যতার বিবেচনায় এক বছর মেয়াদে ডিএনসিসিতে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন মোহাম্মদ এজাজকে। তিনি একজন গবেষক ও ক্লিন ইমেজের মানুষ। সমাজে তার যথেষ্ট সুনাম আছে।
এরপর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা পদে ‘খুলনা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়’ (কুয়েট) থেকে পাস করা প্রকৌশলী,বিসিএস ক্যাডারের (অতিরিক্ত সচিব) আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামানকে। ডিএনসিসির প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দুই জনই ভাল মানুষ হিসেবে সমাজে একটা খ্যাতি রয়েছে। কিন্তু ডিএনসিসিতে যোগদানের পর তাদের অর্জিত সুনাম.খ্যাতি দ্রুত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। কারণ তাদের পরিবারের সদস্য, কাছের এবং এলাকার কথিত বন্ধুরা ডিএনসিসিতে প্রতিটি কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন।
এদিকে প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ আজকের দৈনিক পত্রিকাকে পারিবারিক সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার নাম ব্যবহার করে, যদি কেউ ডিএনসিসিতে তদবির করতে আসে, তাদের আগে বানবেন। পুলিশের হাতে তুলে দিবেন। আমার কোন ভাই, স্বজন, পরিবারের লোকজন ডিএনসিসিতে প্রভাব বিস্তার করা কিংবা তদবির করতে আসে না।’ যারা এসব প্রচার করেন, তারা আমার ভাল চায় না। তদবির করতে আমার কোন লোক নগর ভবনে আসে না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ডিএনসিসিতে কোটি কোটি টাকার কেনা কাটা, রাস্তা,নর্দ্দমা, ফুটপাত, খেলার মাঠ,পার্কসহ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজেরা পাশাপাশি, লোক নিয়োগ ,পুরনো কর্মকর্তা -কর্মচারীদের পদোন্নতি,পদায়ন এবং বদলিতে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার স্বজনদের অতিমাত্রায় তদবিরে অতিষ্ঠ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর ও দুর্নীতিবাজ সাবেক মেয়র আতিকে অনুসারিদের রক্ষায় কতিপয় বিএনপির কেন্দ্রিয় ও মহানগর নেতাও তাদের সাথে যোগ দিচ্ছেন। টানা ১৫ বছরের চিহ্নিত আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতির অভিযুক্তদের নানা কৌশলে বিএনপির ঘনিষ্টজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিযোগিতা চলছে।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমান প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা আগে থেকেই ভাল বাসতেন। উপদেষ্টারা তাকে সরকারের আমলা ও রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে থেকে ডিএনসিসির প্রশাসক হিসেবে নিয়োগে সমর্থণ করেছেন। তবে ইতোমধ্যে তার কথিত শ্যালক, এলাকার লোক, নিবটতম আত্মীয়-স্বজন পরিচয়ে নগর ভবনসহ ডিএনসিসি বেশ প্রভাব বিস্তার শুরু করেছেন। অধিকাংশ বড় বড় টেন্ডার, কেনা কাটা এবং পদোন্নতি ও পদায়নে অতিমাত্রায় তদবিরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিরক্ত হয়ে পড়ছেন। তবে আপা.তত তাদের সম্মান রক্ষায়,নাম ও পরিচয় প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা।
প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরেও তার এলাকার নিকটতম আত্মীয় স্বজন, বন্ধু ও ভাই পরিচয়ে ডিএনসিসিতে অতিমাত্রায় প্রভাব বিস্তার শুরু হয়েছে। মিরপুরে উন্নয়ন কাজে হস্তক্ষেপ, নগরীর অসহায় গরীবদের জন্য গত রমজানে চার হাজার টাকা করে প্রদানের ক্ষেত্রেও ভুয়া তালিকা নিয়ে হাজির হয়েছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ভাই পরিচয়ে জনৈক ব্যক্তি। এই বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া সাবেক মেয়র আতিকের নানা অপকর্মের সহযোগি ডিএনসিসিতে ‘তথ্য ও গবেষণা কর্মকর্মকর্তা পিয়াল হাছানকে’ নগর ভবনে পুনর বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। পরে সংক্ষুব্ধ কর্মকর্তা কর্মচারীদের প্রতিবাদের মুখে ‘ মো.পিয়াল হাছানকে’ নগর ভবনে ভাল দপ্তরে পদায়নের টার্গেট সফল হয়নি।
এদিকে প্রশাসক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের সহযোগিতায় এবং বিএনপির পরিচয়দানকারী কতিপয় নেতার গোপন আতাতে ডিএনসিসির ফ্যাসস্টি সাবেক মেয়র আতিকের বেশ কয়জন অনুসারিকে ভাল দপ্তরে পদায়ন এবং বিএনপি বানানোর চেষ্টা চলছে। এরমধ্যে রয়েছেন, সহকারী প্রকৌশলী মো. কামরুল হাসান, বর্জ্য ব্যবস্তাপনা বিভাগের সহকারী প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মো. আরাফাত হোসেনসহ আরো দুই একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এছাড়াও রাজস্ব বিভাগ,ক্রয় ও ভান্ডার বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগে একাধিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ অনুসন্ধান এবং তদন্ত করছে দুদক।
সাবেক মেয়র আনিসুল হক থেকে প্রশাসক এজাজ স্বজনদের সংক্ষিপ্ত চিত্র:
ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রথম নির্বাচিত ব্যবসায়ি নেতা অস্বাভাবিক প্রভাবশালী মেয়র ছিলেন মো. আনিসুল হক। তিনি মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণের পরই তার ছেলে এবং বাইরের বেশ কয়জনকে অবৈতনিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত করেন। এই উপদেষ্টা পরিষদ তৎকালীন মেয়রের চারপাশে একটি অপ্রতিরোধ্য প্রাচীর গড়ে তোলেন। এমনকি ডিএনসিসির বিভাগীয় প্রধান,উপ প্রধানসহ অনেক কর্মকর্তারা সরাসরি মেয়র আনিসুল হকের সাথে তার কক্ষে প্রবেশ করা কিংবা মতামত প্রকাশের সুযোগ পেতেন না।
শুর তাই নয়, ডিএনসিসির বোর্ড সভায় আনিসুল হক গর্ব করে বলতেন, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞাতা রয়েছে তার ছেলের। ওইসময় তার ছেলের সিন্ডিকেট ডিএনসিসির সব ধরনের বড় বড় কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ উঠলেও প্রতিবাদ করার সাহস কেউ দেখাতে পারেননি। ওইসময় ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিএম এনামুল হকে আপন ছোট ভাই ‘ এমদাদুল হক’ প্রতিদিন নগর ভবনে সকালে আসতেন আর বিকেলে বেরিয়ে যেতেন। এমন কোন দপ্তর নেই,যেখানে এই এমদাদের আযাচিত হস্তক্ষেপ ছিল না। পরে একপর্যায়ে বেশ কয়জন কর্মকর্তা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে তার ভাইয়ের বিষয়ে নালিশ করেন। তবে কিছুর নিরব ছিল এমদাদ, পরে আবার সব কিছুতে হস্তক্ষেপ শুরু করেন।
তবে বিদেশের মাঠিতে তৎকালীন মেয়র আনিসুল হক মারা যাবার পর কিছু দিন ডিএনসিসিতে পারিবারিক স্বজনদের উৎপাত বন্ধ ছিল। এরপর আওয়ামী লীগ ডিএনসিসির নির্বাচনে আরেক ব্যবসায়ি নেতা মো. আতিকুল ইসলামকে মেয়র পদে মনোনয়ন দেন এবং ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে মেয়র নির্বাচিত করান। তিনি মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পরই ভাতিজা, ভাগ্নে, নিকটতম লোকজনকে পিএস, এপিএস. পিএ পদে পদায়ান করেন।
শুধুতাই নয়, অর্গানোগ্রামের বহিভুত নিজের ‘মেয়ে বুশরাকে’ ঢাকা শহরের তাপমাত্রা কমানোর নামে হাস্যকর একটি পদ তৈরি করে’ চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগে দেন। এই বিষয়টি নিয়ে ওই সময় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। পরে মেয়র আতিক তখন বলেন, চিফ হিট অফিসারের বেতন ডিএনসিসি দেবে না, বেতন দেবে বিদেশি একটি কোম্পানি। আর ডিএনসিসি বিল পেমেন্ট করবে ওই কোম্পানিকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নজির বিহীন ঘটনা, মেয়র আতিকরে নির্দেশে মেয়র সেলের গঠন করা সিন্ডিকেট সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়। ওই সিন্ডিকেটের দোসর বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা মিলেমিশে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। ওই সব লোপাাট .দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ এখন দুদক তদন্ত ও অনুুসন্ধান করছে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বর্তামান ক্লিন ইমেজের প্রশাসক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে বির্তকিত করতে তাদের কথিত উপদেষ্টা ও স্বজনরাই যথেষ্ট।
আ. দৈ./ কাশে