দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় এই ঘাটতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিলো ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন ব্যাংকের যে অবস্থা তাতে প্রভিশন ঘাটতি হবে। কারণ দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এর পরও সম্প্রতি খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। তাই প্রভিশন ঘাটতি বাড়বে। এখানে শতভাগ প্রভিশন রাখা দরকার। এখানে একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। এভাবে প্রভিশন বাড়তে থাকলে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে যাবে। প্রভিশন ঘাটতি কমাতে হলে আগে খেলাপি ঋণ কমাতে হবে। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই করে দিতে হবে, যাতে টাকাগুলো আবার ফেরত আসে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। এর আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিলো ৫৫ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতের প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৫০ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে পরিচালন মুনাফার ০.৫ থেকে ৫ শতাংশ সাধারণ ক্যাটাগরির ঋণের বিপরীতে প্রভিশন হিসেবে, নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং সন্দেহজনক খেলাপি ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতিটি ব্যাংকের জন্য মন্দ বা লোকসান ক্যাটাগরির খেলাপি ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশনিং আলাদা করে রাখার বিধান রয়েছে।
প্রভিশন ঘাটতি ব্যাংকিং খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত, কারণ এটি ব্যাংকগুলোর দুর্বল আর্থিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরে, যা মূলত উচ্চ খেলাপি ঋণের ফল। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিলো ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। তিন মাসের ব্যবধানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা বা ১৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিলো ৪০ হাজার ২০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসের ব্যবধানে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ১৭ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বা ৩০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ৪৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বর শেষে যার পরিমাণ ছিলো ১৫ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫২ কোটি টাকা বা ৬৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
অপরদিকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে বিদেশি ব্যাংকগুলোর প্রভিশন সংরক্ষণ করার কথা ছিলো ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। তবে এ ব্যাংকগুলো আলোচ্য এ সময়ের মধ্যে প্রভিশন রেখেছে ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিসেম্বর শেষে বিদেশি ব্যাংকগুলোর ৪৬৩ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। একই সময়ে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোরও উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৫৫ কোটি টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রভিশন রাখার কথা ছিলো ২ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকগুলো রেখেছিলো ৩ হাজার ৮৪ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক থেকে অপব্যবহার করে নেওয়া অর্থ এখন খেলাপি ঋণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালীদের একাধিক ছাড় দেওয়ার ফলে খেলাপি ঋণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এই ছাড় নীতি বাস্তবায়ন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ও ফজলে কবির। সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ নীতি থেকে সরে গিয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা প্রয়োগ করেছে। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণেও ঋণ পরিশোধ কমে গেছে।
র/আ