রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫,
১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ই-পেপার

রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
মতামত
মৃতপ্রায় জীবন কেন ‘খাবার পানি’ চেয়েও পায় না
শেখ তাসনিম আফরোজ
Publish: Saturday, 14 September, 2024, 10:48 AM  (ভিজিট : 135)
সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ।

সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ।

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে ঘাতকের গুলিতে নিহত হন। পায়ে ও পেটে গুলি লাগার কারণে তিনি গুলি করার পরও অনেক সময় বেঁচে ছিলেন। রক্তক্ষরণের কারণে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। পাশের সেলের কারাবন্দীরা জানিয়েছিলেন, গুলির পরেও প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে একজনের আর্তনাদ শুনেছিলেন তাঁরা। আর ‘পানি, পানি’ বলে মৃত্যুর আগপর্যন্ত কাতরানোর মর্মভেদী শব্দ তাঁদের কানে আসছিল। কিন্তু ঘাতকেরা চলে যাওয়ার আগে সেলটি খুব শক্তভাবে তালাবদ্ধ করে রেখে যাওয়ায় মৃত্যুর আগে তাজউদ্দীনের মুখে এক ফোটা পানিও কেউ তুলে দিতে পারেননি। ওই পিপাসা নিয়েই চলে যেতে হয় তাঁকে।

এর অনেক বছর পর আমাদের নাড়িয়ে দেয়া আরেকটি ঘটনা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর স্বৈরাচারী সরকারের নিপীড়ক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পেটাতে পেটাতে মেরেই ফেলে ছেলেটিকে। ছেলেটি দেশ নিয়ে ভাবত। ফেনী নদীর পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে করা ফেসবুকের একটি পোস্টই কাল হয়েছিল তার।

আবরার মৃত্যুর আগে পানি খেতে চায়, কিন্তু পানি না দিয়ে হামলাকারী ছাত্রলীগের এক নেতা বলে, ‘ও ভান করছে, আরও পেটালে ঠিক হয়ে যাবে।’ এরপর আবরারের ওপর শুরু হয় আবারও স্টাম্প দিয়ে নির্যাতন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও পেটানো হয় ছেলেটিকে। বুয়েটকে নোংরা ছাত্ররাজনীতির থাবা থেকে মুক্ত করার দাম ছেলেটিকে জীবন দিয়ে চোকাতে হয়।

আচ্ছা, কাউকে পেটাতে পেটাতে কেউ যখন তাকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়, তখন কি আঘাতকারীর মাথায় একটিবারও আসে না, সে কী করছে? নিজের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণার লালন করলে একটি মুমূর্ষু মানুষকে পানি না দিয়ে থাকা যায়? পানি চাওয়ার পরেও? তারপর যখন কেউ জানতে পারে যে সে বা তারা পেটাতে পেটাতে একজন মানুষকে মেরেই ফেলেছে, শেষ সময়ে পানি চাইলেও খেতে দেয়নি, তখন কী অনুভূতি হয় ঘাতকদের? একটুও অনুশোচনা কি হয়? একটুখানি আক্ষেপ? ভীষণ জানতে ইচ্ছা করে।

৭ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে ঘটে যায় আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। গণপিটুনিতে নিহত হন ছাত্রলীগের সাবেক কর্মী আবদুল্লাহ আল মাসুদ। গণপিটুনির ঘটনা সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষের গা সওয়া হয়ে গেছে হয়তো, তা না হলে এত এত সহিংসতায় মানুষ চুপ কী করে থাকতে পারছে, যারা কেবল এক মাস আগেই দেশের সবচেয়ে অত্যাচারী স্বৈরাচারকে বুকের রক্ত দিয়ে তাড়াল?

মাসুদের ঘটনাটি হৃদয়ে আলাদাভাবে আলোড়ন তোলার কিছু কারণ আছে। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল সকালে ক্লাসে যাওয়ার পথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়া হলের সামনে হামলার শিকার হন মাসুদ। ওই হামলায় মাসুদের ডান পায়ের নিচের অংশ গোড়ালি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাঁ পা-ও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেটে দেয়া হয়েছিল হাতের রগ। সেই সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন।

ওই সময় মাসুদ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছিলেন, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা তাঁর ওপর সেই হামলা চালিয়েছিল। ওই হামলায় পা হারিয়ে মাসুদ একটি প্লাস্টিকের পা লাগিয়ে চলাচল করতেন। তাঁর অন্য পাও গত শনিবার রাতে ভেঙে দেয়া হয়।

গত ২০ জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত সন্তান তাঈমের লাশ খুঁজে পাওয়ার পর রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের উপপরিদর্শক বাবা ময়নাল হোসেনকে ফোনে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, ‘একজনকে মারতে কতগুলো গুলি লাগে স্যার?’ সেই প্রশ্নের উত্তরে স্যার কী বলেছিলেন, জানা নেই। তবে সেভাবেই জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, একজনকে মারতে কতবার আঘাত করা লাগে? একজন মানুষকে পঙ্গু বানিয়ে দেয়াও কেন ঘৃণা কমানোর পক্ষে যথেষ্ট হয় না?

কী দোষ ছিল মাসুদের? কী এমন গুরুতর অপরাধের শাস্তি দেয়ার জন্য আইন–আদালতের ওপর ভরসা করতে পারল না হামলাকারীরা? এর উত্তর আমাদের জানতেই হবে। জানতে হবে ৫ সেপ্টেম্বর উৎসব মণ্ডল নামের ছেলেটিকে তার বাবা থানায় নিয়ে আসার পরও পুলিশ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে গুরুতরভাবে আহত করা হলো। আমরা জানি না, উত্তেজিত জনতার ‘উত্তেজনার’ উৎস কী?

পুলিশ কর্মকর্তার ভাষ্য অনুযায়ী, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে রাতে বিনোদপুর বাজারে মাসুদের ওপর হামলা হয়। পরে একদল শিক্ষার্থী তাঁকে প্রথমে মতিহার থানায় নিয়ে যান। কিন্তু মতিহার থানায় ৫ আগস্টের সহিংসতার কোনো মামলা নেই। তাই তাঁকে বোয়ালিয়া থানায় আনা হয়, যেন তাঁকে কোনো সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।’

একজন আধমরা মানুষকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়া প্রয়োজন ছিল, নাকি মামলা দেয়া? মতিহার ও বোয়ালিয়া থানায় যে কালক্ষেপণ করা হয়েছে, সেই সময়ের মধ্যে সদিচ্ছা থাকলে বাঁচানোর চেষ্টা করা যেত না মানুষটাকে? সেই চেষ্টা কেন করা হয়নি? উত্তেজিত জনতার ভয়ে, নাকি নিজেদের গাফিলতির কারণে?

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচারের সময় মৃত্যুপথযাত্রী মুক্তিযোদ্ধারা পানি চাইলেও পাননি, এমন ঘটনাও আমরা শুনে থাকি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলে। দেশের ইতিহাসে লাশের রাজনীতির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় না থাকলেও লাশ যে ন্যূনতম একটি সঠিক সংখ্যারও পর্যন্ত মর্যাদাটুকু পায় না, এ আমাদের জাতীয় লজ্জা।

মাসুদ মাত্র কয়েকদিন আগে কন্যাসন্তানের বাবা হন। মেয়ের জন্য ওষুধ কিনতে বের হওয়াই কাল হয়ে দাঁড়ায় মাসুদের জন্য। মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি নবজাতকের ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেন। বাবা হওয়ার খবর জানান সবাইকে। ঘাতকদের কেউ কি সেই পোস্ট দেখেছিল? তারা কেউই কি ভাবেনি, মাসুদের পাঁচ দিন বয়সী মেয়ের কথা? সদ্য প্রসূতি স্ত্রীর কথা? একটি নিষ্পাপ নবজাতককে এতিম না করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত?

ফেসবুকে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। মৃত্যুপথযাত্রী মাসুদ কাতর হয়ে বলছেন, ‘আমাকে পানি খাওয়ান, বাবা।’ ‘কারোর পানি লাগবে? পানি!’ বলতে বলতে শহীদ হয়ে যাওয়া মুগ্ধর কানে সেই আকুতি পৌঁছেছে কি না, দেশের মানুষের এই পরিণতি হওয়ার জন্য মুগ্ধ জীবন দিয়েছিল কি না, সেসব বোঝাপড়া আপাতত ওরা দুজনেই করে নিক। আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য প্রাণবায়ু ফুরানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সে পর্যন্ত নাহয় মৃত্যুর সময় পানি খেতে পারার আকুতিটুকুই জানিয়ে যাই।

লেখক: শেখ তাসনিম আফরোজ, সাবেক ভিপি, শামসুন নাহার হল সংসদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

কক্সবাজারের সাবেক এমপি জাফর ঢাকায় গ্রেফতার
আইন উপদেষ্টার বাসায় পড়ে থাকা ড্রোনে ধ্বংসাত্মক ডিভাইস পাওয়া যায়নি
মেট্রোরেল-বিদ্যুৎ-সড়ক-রেলে সেবা বিঘ্নিত হলে দুঃখ প্রকাশ বাধ্যতামূলক
রোম থেকে দেশের পথে প্রধান উপদেষ্টা
নির্বাচনে প্রতিটি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা চায় জামায়াত
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

ডিএনসিসিতে বর্জ্যব্যবস্থাপানা বিভাগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের অভিযান
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জাতীয়তাবাদী কর্মজীবী দলের সভা
পদত্যাগ করলেন আটাবের সবুজ মুন্সী
ঢাকা দুই সিটিতে আওয়ামী দোসর ও দুর্নীতিবাজদের রক্ষায় বিএনপির ব্যাপক তদবির
রানা প্লাজা ট্রাজেডির ১২ বছর , তবু মেলেনি বিচার, নিশ্চিত হয়নি ক্ষতিপূরণ
মতামত- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
নির্বাহী সম্পাদক : তৌহিদুর রহমান, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক: মাসুদ আলম

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : ajkerdainik@gmail.com
About Us    Advertisement    Terms & Conditions    Privacy Policy    Copyright Policy    Circulation    Contact Us   
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝