ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) শাহবাগস্থ কেন্দ্রিয় শিশু পার্ক প্রকল্পের পরিচালক তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএস লি. এর মালিক মো. আজমত হোসেনসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লোপোটের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশন ইতোমধ্যে এই অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ করেছেন বলে জানা যায়।
সূত্রমতে, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের দাপটে ৭৮ কোটি টাকা থেকে ৬০৩ কোটি টাকা শাহবাগের শিশুপার্ক আধুনিকায়ন প্রকল্পের ব্যাপক অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে গত ১০ জুলাই দুদকের অভিযোগ জমা পড়ে।
এরপর গত ২৯ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিক প্রত্রিকায় 'শাহবাগের শিশুপার্ক' আধুনিকায়ন প্রকল্পে লোপাটের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে প্রকল্পের পরিচালক তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, অতিরিক্ত দামে যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা লোপাটের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
এদিকে দুদকের পক্ষ থেকে উক্ত তদন্ত সংস্থার 'দৈনিক ও সা¤প্রতিক অভিযোগ সেল' প্রাপ্ত অভিযোগ এবং জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি প্রাথমিক যাচাই বাছাই শেষে অনুসন্ধানের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরে গত ১৫ সেপ্টেম্বর 'দৈনিক ও সা¤প্রতিক অভিযোগ সেলের' পরিচালক উত্তম কুমার মন্ডল স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে ওই অভিযোগটি অনুসন্ধানের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবহিত করা হয়। এরপর অনুসন্ধানী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। তবে গোপনীয়তার স্বার্থে অনুসন্ধানী কর্মকতার নাম ও পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। এবার দেখা যাক দুদকের অনুসন্ধানে কি বেরিয়ে আসে।
নাম না প্রকাশের শর্তে ডিএসসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, শাহবাগস্থ কেন্দ্রিয় শিশু পার্ক প্রকল্পের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টরা শুরু থেকেই নানা অনিয়ম এবং লোপাটের নজির স্থাপন করেছেন। প্রথমে এই পার্কের পুরনো মূল্যবান যন্ত্রাপাতি, রাইডার, খেলানাগুলো নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি দেখিয়ে অর্ধকোটি টাকা লোপাট করেছেন। যা তদন্ত হলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসবে।
এরপর প্রকল্পের ব্যয় ইচ্ছামাফিক বাড়িয়েছেন। প্রথম সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের আমলে ২০১৮ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে একটি চিঠি আসে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে। ওই চিঠিতে শাহবাগের শিশুপার্ক সংস্কার ও আধুনিকায়নের জন্য একটি প্রকল্পের আওতায় ডিএসসিসিকে ৭৮ কোটি টাকা দেয়ার প্রস্তাব দেয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
ওই প্রকল্পের জন্য শিশুপার্কের নিচ দিয়ে ভ‚গর্ভস্থ পার্কিং হবে। এতে পার্কের কিছু রাইড (খেলনার উপকরণ ও বিনোদনের সরঞ্জাম) ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নতুন রাইড কেনার পাশাপাশি পার্কের আধুনিকায়নের জন্য মূলত ওই টাকা দিতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু এত ‘অল্প টাকায়’ আধুনিকায়নের কাজটি করা যাবে না উল্লেখ করে প্রস্তাবটি ফেরত পাঠায় তখনকার মেয়র সাঈদ খোকন।
এরপর ২০২০ সালের মে মাসে শেখ ফজলে নূর তাপস ডিএসসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওই প্রস্তাবের বিষয়টি আমলে নেয়। তিনি মন্ত্রণালয়ের ৭৮ কোটি টাকা না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি শিশুপার্কের আধুনিকায়নের কাজটি নিজেরাই করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সাথে শিশুপার্ক প্রকল্পের জন্য ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকা বরাদ্দ করেন।
তৎকালীন মেয়র তাপস ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রকল্পটি ২০২৩ সালের আগস্টে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন করান। বরাদ্দকৃত ৬০৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার মধ্যে ৪৮৩ কোটি টাকা দেবে সরকার। সরকারের দেয়া টাকার অর্ধেক হবে অনুদান, বাকিটা ঋণ হিসেবে দেয়া হবে। আর ডিএসসিসির নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করা হবে ১২০ কোটি টাকা।
এই প্রকল্পের বেশির ভাগ ব্যয় (৪৪১ কোটি টাকা) ধরা হয় শিশুপার্কের জন্য ১৫টি রাইড কেনা ও স্থাপনে। এসব রাইডের দাম নিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেসরকারি খাতে বিনোদনকেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনজন উদ্যোক্তা গণমাধ্যমকে বলেন, রাইডের যে দর দেখানো হয়েছে, তা অবিশ্বাস্য। সরকারি কাজ, তাই অস্বাভাবিক বেশি দাম ধরা হয়েছে। বিভিন্ন রাইডের দাম এতটা বেশি কেন ধরা হয়েছে, তা কারও না বোঝার কারণ নেই।
একসঙ্গে ৩০ জন চড়তে পারে এমন একটি রাইড ‘মাইন ট্রেন’ (মাইন কোস্টার নামেও পরিচিত) কেনা ও স্থাপন করার জন্য ৯৭ কোটি টাকা খরচ করার কথা প্রকল্পে উল্লেখ করেছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ। এই রাইডের জন্য প্রকল্পে যে ধরনের বৈশিষ্ট্য ও মানের কথা বলা হয়েছে, তাতে এর দাম কোনোভাবেই ৫ কোটি টাকার বেশি হবে না। ঢাকা ও এর আশপাশের চারটি বড় বিনোদনকেন্দ্র পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব যন্ত্র আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ জন্য দাম বেশি পড়ছে। এরপরও দরপত্রের মাধ্যমে কম দামে যন্ত্র কেনা গেলে তাঁরা সেটা কিনবেন।
এই প্রকল্পে ‘১২ডি থিয়েটার’(দর্শকের কাছে মনে হবে সবকিছুই যেন জীবন্ত) স্থাপন করতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮১ কোটি টাকা। এই থিয়েটারের ভেতরে একসঙ্গে ৩৬ জন মানুষ বসতে পারবে। এ ধরনের একটি থিয়েটার নির্মাণ করতে সাকল্যে সাড়ে চার কোটি থেকে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয় বলে জানান ঢাকার উত্তরার একটি বেসরকারি বিনোদনকেন্দ্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একই আকৃতির থিয়েটার কেউ যদি ইউরোপের স্ট্যান্ডার্ডে নির্মাণ করেন, তাহলে সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা খরচ হবে।
এই প্রকল্পের রাইডগুলোর মধ্যে ‘ডিসকো মেগার’ দাম ধরা হয়েছে ২৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এই রাইড মূলত নৌকা আকৃতির কাঠামো, ভেতরে ৪০ জন বসতে পারে। রাইডটি দুলতে থাকে। এ ছাড়া ‘সুপার এয়ার রেসের’ দর ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। এটি দেখতে কিছুটা নাগরদোলার মতো। আশুলিয়া ও নরসিংদীর দুটি বিনোদনকেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, সর্বোচ্চ ভালো মানের হলেও রাইড দুটির দাম ২০ কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। যদিও সিটি করপোরেশন রাইড দুটি কিনতে চাইছে ৭৭ কোটি টাকায়।
এমনকি সিটি করপোরেশনের এই প্রকল্পে একটি জিপ গাড়ি ও একটি পিকআপ কেনার জন্য ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়। পার্কের আধুনিকায়নে এই গাড়ি কী কাজে লাগবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
একইসঙ্গে ৩০ জন চড়তে পারে এমন একটি রাইড ‘মাইন ট্রেন’ (মাইন কোস্টার নামেও পরিচিত) কেনা ও স্থাপন করার জন্য ৯৭ কোটি টাকা খরচ করার কথা প্রকল্পে উল্লেখ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ। এই রাইডের জন্য প্রকল্পে যে ধরনের বৈশিষ্ট্য ও মানের কথা বলা হয়েছে, তাতে এর দাম কোনোভাবেই ৫ কোটি টাকার বেশি হবে না।
সাধারণত দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনুমোদন হওয়ার পর কাজ শুরু হতে বেশ দেরি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেড় বছরও সময় লাগে। কিন্তু এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয় অত্যন্ত দ্রæততার সঙ্গে। তাপসের পছন্দের পাঁচজনকে ঠিকাদারকে কাজটি ভাগ করে দেয়া হয়। অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। প্রকল্প পাস হওয়ার পর দ্রুতই ৫৫ লাখ টাকা ছাড় করা হয়। চলতি অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা ছাড় করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
সূত্র বলছে, তৎকালীন মেয়র তাপস ও জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার আগ্রহে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদি প্রকল্প নেয়া হয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। তা না হলে এত দিনে এই প্রকল্পের জন্য ১০০ কোটি টাকা (চলতি অর্থবছরের জন্য) ছাড় হয়ে যেত।
একাধিক সূত্র বলছে, প্রকল্পটি ২৬৫ কোটি টাকার। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে শুরু হয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে প্রকল্পটি সংশোধন করে ৩৯৭ কোটি টাকা করা হয়। সঙ্গে মেয়াদও বাড়ানো হয়। সব ঠিক থাকলে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
এদিকে এই প্রকল্পে পরিচালক তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী মো. আনিছুর রহমান শাহবাগের শিশুপার্ক আধুনিকায়ক প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম, যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এবং দুদকের অনুসন্ধান প্রসঙ্গে এই প্রতিবেদককে বলেন, এসব বিষয়ে তিনি অবগত নন। দুদকের অনুসন্ধান শুরু হবার বিষয়ে তিনি কোন চিঠি পাননি। যার ফলে দুদকের অনুসন্ধান সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে চাননি। শাহবাগের শিশুপার্ক প্রকল্পের যন্ত্রাপাতি ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতি এবং অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়নি।
আ. দৈ./ কাশেম