দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম কর্মদিবসেই চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে দুদক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কঠোর বার্তা দিয়েছেন ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন।
তিনি বলেছেন, দেশের আলোচিত বড় বড় দুর্নীতির কারণে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এমন বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। কোন অবস্থায়ই দুর্নীতিবাজরা যেন ছাড় না পায়। দুর্নীতিবাজদের শক্তভাবে ধরতে হবে। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও জনপ্রত্যাশিত বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে। নতুন চেয়ারম্যান বলেন,আগামী ৭দিনের মধ্যে নতুন কমিশনের সদস্যরা স্থাবর, অস্থাবর আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করবেন।
আজ বুধবার (১১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে নয়া কর্মস্থলে যোগদানের পর কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক শেষে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সাখে খোলামনে এসব কথা বলেন ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। একই সঙ্গে দুদকে যোগদান করেন নতুন কমিশনার সাবেক জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী।
আজ দুপুর থেকেই দুদকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তারা নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনারকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত ছিলেন। বুধবার বিকাল সাড়ে ৩টায় দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এবং নতুন কমিশনার সাবেক জজ মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী। তাদেরকে অভ্যর্থনা জানান দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন, মহাপরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলী,মহাপরিচালক আক্তার হোসেনসহ কর্মকর্তারা।
তবে দুদকের নতুন অপর কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ দেশের বাইরে অবস্থান করায় তিনি যোগদান করতে পারেননি। আগামী ১৭ ডিসেম্বর কমিশনার হিসেবে তিনি যোগ করবেন বলে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে দুদকের নতুন চেয়ারম্যান বলেন, দুর্নীতি দমনে তার নেতৃত্বোধীন কমিশন সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নিজেদের সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করবেন বলেও জানান। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধের অভিযোগ আছে। সেগুলো আপনারা (সাংবাদিকদের) তদন্ত করে দেখতে পারেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করেছে। শেষ পর্যন্ত কিছুই পায়নি। এটা একটা হয়রানি বলে তিনি মনে করেন। এরআগে মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) বিকালে দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনের তথ্য অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর ৫ (১) ধারার বিধান মতে ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেনকে কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ (২০০৪ সনের ৫ নম্বর আইন)- এর ৬ (১) ধারার বিধান মতে উল্লিখিত দুইজনকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার নিয়োগ করা হয়।
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন দুদকের নতুন চেয়ারম্যান। তিনি বলেছেন, দুর্নীতি একেবারে নির্মূল করতে পারবো কিনা, সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া ঠিক হবে। তবে দুর্নীতি দমনে সাধ্যমত কাজ করার চেষ্টা করবেন। আইন মেনে ন্যায়নিষ্ঠার সাথে কাজ করবেন।
নিজের রাজনৈতিক পরিচয় প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, তিনি তিনটি রাজনৈতিক সরকার ও দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। এই অন্তর্র্বতী সরকারের অন্য রাজনৈতিক দলের মতো কোনো রাজনৈতিক চরিত্র নেই। রাজনৈতিক চাওয়া নেই। এই সরকারের চাওয়া হচ্ছে জনগণকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এখানে রাজনৈতিক সরকার প্রভাবিত করবে না। আমরাও প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাবো।
তিনি সাংবাদিকদের আরও বলেন, সমাজ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, দুদকও খানিকটা দুর্নীতিগ্রস্ত হতেও পারে। আমার বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে, সেটিও আপনারা দেখবেন। যে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ন্যায়নিষ্ঠভাবে আপনারা দেখবেন।
উল্লেখ্য,দুদকের নতুন চেয়ারম্যান আবদুল মোমেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) সহকারী একান্ত সচিব ও পরিচালক, বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক, কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক, ঢাকার জেলা প্রশাসক, ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের পরিচালক, অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক, বিআরটিএর চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিমানের এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
যুগ্মসচিব থাকার সময় ২০০৯ সালে আবদুল মোমেনকে ওএসডি করে আওয়ামী লীগ সরকার। পরে ২০১৩ সালের ৬ জুন তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়।
এদিকে দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনাদের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে তাদের আয় ও সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করা সহ তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে ওইসব তথ্য প্রকাশের আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
আজ বুধবার (১১ ডিসেম্বর) এক সংবাদ বিবৃতিতে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই আহবান জানিয়েছেন। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, জাতির ক্রান্তিলগ্নে জনপ্রত্যাশার কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান দুদকের শীর্ষ অবস্থানের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিতের স্বার্থে কিছু বিষয়ে স্বপ্রণোদিতভাবে প্রকাশের জন্য আহ্বান জানান।
বিবৃতিতে দুদকের নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনাদের নিজের ও পরিবারের সদস্যদেও নামে-বেনামে অর্জিত আয় ও সম্পদের তথ্য। আয়ের বৈধ সূত্রের সঙ্গে অর্জিত আয় ও সম্পদের সামঞ্জস্যতার তথ্য। নিরপেক্ষ নিরীক্ষক কর্তৃক আয় ও সম্পদ বিবরণীর যথার্থতা, পর্যাপ্ততা ও সামঞ্জস্যতা যাচাইয়ের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। পেশাগত জীবনের কোনো পর্যায়ে কোনো প্রকার ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগের প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত তথ্যের বিষয়ে নিজের অবস্থান। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দলীয় রাজনৈতিক আনুগত্যের তথ্য এবং উল্লিখিত বিষয়ে কোনো প্রকার অসামঞ্জস্যতার ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় তদন্ত সাপেক্ষে জবাবদিহি করতে প্রস্তুত মর্মে ঘোষণা।
আ. দৈ./ কাশেম